খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করলেই সমাধান নয়
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক । চলমান রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন ‘জাগো নিউজ’-এর। আগাম নির্বাচন নিয়ে গুঞ্জন উঠলেও, তা উড়িয়ে দেন আওয়ামী লীগের এই নেতা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : আগাম নির্বাচন নিয়ে ফের গুঞ্জন উঠছে। নির্বাচন নিয়ে সরকার কী হিসেব কষছে?
খালিদ মাহমুদ চৌধুরী : আগাম নির্বাচনের দাবিতে বিরোধী জোট আন্দোলন করেছিল। তারা ঘরে ফিরে গেছে। আমি শুধু বলব, যে পরিস্থিতিতে একটি দেশে আগাম নির্বাচনের প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়, সেই রকম পরিস্থিতি বাংলাদেশে নেই। সবকিছুই সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই চলছে। বিশ্বব্যাংকসহ সব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। তারা এই সরকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরালো হচ্ছে। সাংবিধানিক এমন কোনো সংকট তৈরি হয়নি যে কারণে আগাম নির্বাচন দিতে হবে।
জাগো নিউজ : রাজনৈতিক সংকট তো আছে এবং তা গত নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই?
খালিদ মাহমুদ : গত নির্বাচন সাংবিধানিক বিধি মেনেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক কোনো সংকট ছিল বলেও আমি মনে করি না। যারা রাজনৈতিক সংকট তৈরি করার চেষ্টা করেছিল, তাদের রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করা হয়েছে। এখন দেশে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে।
জাগো নিউজ : অভিযোগ রয়েছে, সরকার খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের অযোগ্য করতে এবং বিএনপিকে ভাঙতে চায়। কেউ আবার একে আগাম নির্বাচনের ইঙ্গিতও মনে করছেন?
খালিদ মাহমুদ : ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’। বিএনপির এখন এমন দশা। বিএনপি রাজনৈতিকভাবে গণবিচ্ছিন্ন, পর্যুদস্ত, গণধিকৃত একটি দল। আন্দোলন করার মতো সাহস হারিয়ে ফেলছে বলেই এই ধরনের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে বিএনপি বেঁচে থাকতে চাইছে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। আইনানুগভাবেই খালেদা জিয়ার বিচার হচ্ছে। সরকার এই মামলাকে কোনোভাবেই রাজনীতিকীকরণ করেনি। রাজনীতিকীকরণ করলে অনেক আগেই এই বিচার সম্পন্ন হয়ে যেত। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হচ্ছেন না। মামলার কাজ বিলম্ব করার জন্য খালেদা জিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
খালেদা জিয়া আইনের মধ্য দিয়ে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে বেরিয়ে আসলে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হব। কেউ চাই না বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হোক। সুতরাং আমি মনে করি, বিএনপি মামলা নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বাঁচতে চাইছে।
জাগো নিউজ : এরকম অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে। খালেদা জিয়ার মামলার ব্যাপারে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে কি-না?
খালিদ মাহমুদ : খালেদা জিয়া নিজেই আইন আদালতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি দিনের পর দিন আদালতে হাজিরা দেয়া থেকে বিরত রয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, একটি দলের প্রধান হিসেবে তাকে বিশেষ ছাড় দেয়া হয়েছে, যা সাধারণ মানুষ পায় না। তিন দিন আদালতে হাজিরা না দিলেই ওয়ারেন্ট হয়ে যায়। খালেদা জিয়াকে সম্মান করেই আইন, আদালত তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তিনি আইনকে সম্মান করছেন না। কিন্তু সরকার তার সম্মান বজায় রাখছে।
জাগো নিউজ : আইন তো সবার জন্য সমান। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হলো। গ্রেফতার হলেন না। আসলে এই মামলার ভবিষ্যৎ কি?
খালিদ মাহমুদ : খালেদা জিয়া কেন গ্রেফতার হলেন না, সেটা আদালত দেখবে। আমি মনে করি, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করলেই সমাধান নয়। আইনগতভাবে তার বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করাই হচ্ছে সমাধান।
দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা সরকারের দায়িত্ব। কাউকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে দেশে অশান্তি সৃষ্টি হলে সেটাও সরকারের বিবেচনায় আনতে হয়। সরকার তো প্রতিহিংসাপরায়ণ নয়। এই বিবেচনায় সরকার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি বলে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
জাগো নিউজ : সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা আন্তর্জাতিক মহলও বলছে?
খালিদ মাহমুদ : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মতো একটি বড় দল অংশ নেয়নি। এটি অনেকের কাছেই খটকা লেগেছে। আন্তর্জার্তিক মহল চাইছে পরবর্তী নির্বাচন যেন সবার অংশগ্রহণে হয়। আমারও চাই ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করুক। একটি রাজনৈতিক দলের ভুলের কারণে সংবিধানকে তো পদদলিত করা যায় না।
জাগো নিউজ : ছাত্রলীগের এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় ছিল বলেই মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এত উন্নয়ন করেছে। সরকার সে পথেই হাঁটতে চাইছে কি না?
খালিদ মাহমুদ : জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নয়ন হবেই। ভারতে কংগ্রেস ছিল বলেই উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের ৪৪ বছরের ইতিহাসে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি যদি ক্ষমতায় থাকত, তাহলে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দিতে হতো না। তারাই বাংলাদেশের উদাহরণ দিত। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় ছিল না বলেই দেশে সেই অর্থে উন্নয়ন হয়নি।
এই সরকারকে অনেকেই সমালোচনা করছেন। কিন্তু তাদেরকে মানতে হবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, এটি স্বীকার করতেই হবে।
জাগো নিউজ : এমন উন্নয়ন নিয়ে সমালোচনাও আছে। উন্নয়নে জনমর্থন মেলে না ২০১১ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তার প্রমাণও মিলছে?
খালিদ মাহমুদ : সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমরাও জিতেছি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধেরও বিরোধীতা করা হয়েছিল। সুতরাং এই সরকারের সমালোচনা হবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। আমরা ’৭১-এর পরাজিত শক্তিকে তো একেবারে নিঃশেষ করতে পারিনি।
যারা সরকারের গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে আলাদা করে দেখছে, তারা মূলত রাজনৈতিক হীন স্বার্থেই দেখছে। স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনও তৎপর। বঙ্গবন্ধু তাদের ক্ষমা করলেও, তারা সেই সুযোগ গ্রহণ করেনি। ’৭৫-এর পর তারা আবারও দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে সক্রিয় হয়েছে। এই শক্তিকে যতক্ষণ আমরা সমূলে উৎপাটন করতে পারব না, ততক্ষণ আমরা গণতন্ত্র এবং উন্নয়নে ভারসাম্য আনতে পারব না।
জাগো নিউজ : জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে ভারতের কংগ্রেসের কথা বলছিলেন। কংগ্রেসের বিপরীতে তো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপি-ও দাঁড়িয়ে গেল?
খালিদ মাহমুদ : ভারতের গণতন্ত্র এবং উন্নয়নে কংগ্রেসের অবদানের কথা বলেছি। বিজেপি হিন্দুত্ববাদ ধারণ করে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে বটে কিন্তু তারাও এখন অখণ্ড ভারত এবং জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে একাট্টা। বিজেপিও অসাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষের স্পিরিট নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীরা এখনও এই স্পিরিটটা ধারণ করেনি।
জাগো নিউজ : এই স্পিরিট ধারণে আওয়ামী লীগেরও ব্যর্থতা আছে কি না?
খালিদ মাহমুদ : এখানে আওয়ামী লীগের কোনো ব্যর্থতা আছে আমি তা মনে করি না। ’৭৫-এর পর আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাই পাল্টে দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিকৃতি ইতিহাস নিয়ে ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। এ কারণে সামাজিক চিন্তা-চেতনাও বিকৃত হয়।
জাগো নিউজ : আওয়ামী লীগও কয়েকবার ক্ষমতায় এল?
খালিদ মাহমুদ : আমরা ক্ষমতায় এসে বিষয়গুলোর মীমাংসা করার চেষ্টা করছি। আমরা চেষ্টা করছি বলেই মানুষ সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করছে।
এএসএস/এসকেডি/এমএস