নিজে করেছেন ভিক্ষা, ১৪০০ অনাথ শিশুর ভার তার কাঁধে
সন্তান জন্ম দিয়ে ভারতে দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই তাদের ফেলে রেখে চলে যায়। তাদেরই কুড়িয়ে পরম মমতায় বুকে তুলে নেন এক নারী। একজন, দু’জন নয়, ১৪শ’রও বেশি শিশুর খাওয়া পরার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। ৭০ বছর বয়সী এই মহিয়সী নারীর নাম সিন্ধুতাই সাপকাল। এমন কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি প্রায় ৭৫০টি পুরস্কার পেয়েছেন। তাকে ‘অনাথ জননী’ উপাধি দেয়া হয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, ভারতের মহারাষ্ট্রের পুণেতে চারটি অনাথ আশ্রম আছে সিন্ধুতাই সাপকালের। এর মধ্যে দুটি মেয়েদের , দুটি ছেলেদের জন্য। এ কাজে তার মেয়ে মমতা তাকে সাহায্য করেন। আর প্রথম পালিত পুত্রটিও সহায়তা করেন অনাথ আশ্রমগুলো পরিচালনার কাজে। এই পরিত্যক্ত শিশুদের বেশিরভাগই পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন নিজেদের জীবনে। এমনকি কেউ কেউ আইনজ্ঞ, ডাক্তার কিংবা অধ্যাপকও হয়েছেন।
গোয়ালে সন্তান জন্ম দেয়া এই নারীর সংগ্রামী জীবন
রেল স্টেশন, পরিত্যক্ত আস্তাকুঁড়, আবর্জনার স্তূপ, এমনকি রাস্তার কুকুরের মুখ থেকেও ছোট ছোট শিশুদের উদ্ধার করে সিন্ধুতাই ঠাঁই দেন তার আশ্রমে। একবার তার আশ্রমে কোনও অনাথ শিশু এলে কখনও তিনি তাদের তাড়িয়ে দেন না। সরকার চালিত অনাথ আশ্রমগুলোর মত তিনি কখনই ১৮ বছর হতে না হতেই তাদের বের করে দেন না।
সিন্ধুতাই বলছিলেন, ‘১৮ বছরের পরও বাচ্চারা আমার কাছেই থাকে। আমি তাদের বিয়ের ব্যবস্থাও করি। তারা সংসার পাতালে সেখানেও সাহায্য করি’।
‘১৮ বছর হয়ে গেলেই তো তারা খুব বিচক্ষণ হয়ে যায় না। বরং এ সময়টাতেই আরও বেশি করে অভিভাবকের ভালোবাসা জরুরি। নয়ত বিপথগামী হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। পাখির ডানা আছে মানেই সে উড়তে শিখে গেছে, এমন ভাবাটা ঠিক নয়’, যোগ করেন তিনি।
সিন্ধুতাই সাপকালের এই সেবামূলক কাজে আসার পেছেনে রয়েছে তার নিজের জীবনের দুঃখ কষ্ট। খুব গরিব ঘরে জন্ম। ৯ বছর বয়সে পড়াশোনা ছাড়তে হয় তাকে। ১০ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। এরপর আরও ১০ বছর কাটে নানা দুঃখ দুর্দশায়। তারপর ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামী তাকে ঘর থেকে বের করে দেন। গোয়াল ঘরে সন্তানের জন্ম দেন তিনি।
করুণ এই জীবন কাহিনির স্মৃতিচারণ করতে করতে সিন্ধুতাই বলেন ‘গোয়ালে সন্তানের জন্ম দিলাম। মেয়ের নাড়ি পড়ে আছে দেখে নিজেই পাথর দিয়ে তা কাটলাম। তারপর আত্মীয় স্বজনের দুয়ারে দুয়ারে গেলাম, মায়ের কাছেও গেলাম। কেউ আশ্রয় দিল না। সবাই তাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে।’
৪০ বছর ধরে গ্রামে গ্রামে ঘোরেন তিনি
তিনি জানান, ভিক্ষে করে, ট্রেনে গান গেয়ে গেয়ে তিনি নিজের আর সদ্যজাত কন্যার পেট চালিয়েছেন। সেই সময় রাস্তায় রাস্তায় তিনি অনেক অনাথকে দেখেন, তারই মতো বেঁচে থাকার লড়াই করছে। খাবার ভাগ করে খেতেন তাদের সঙ্গে, শুনতেন তাদের জীবনের কথা। মৃত্যুপথযাত্রী একজন ভিক্ষুকে একটু খাবার আর পানি দিয়ে মনে হয়েছিল, পরের জন্য কিছু করতে পারাটাই জীবনের আসল কাজ।
তখন থেকেই তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, সাধ্যমতো আশ্রয় আর খাবার তুলে দেবেন আশ্রয়হীন, অন্নহীনদের। নিজের জীবনের দারিদ্র্য বাধা হয়নি এই মহৎ কাজে। ৪০ বছর ধরে বহু গ্রাম ঘুরে ঘুরে তিনি বক্তৃতা দিয়ে দান সংগ্রহ করেছেন। ভিক্ষে করে, গান গেয়ে পয়সা তুলে অনাথদের মুখে ভাত জুগিয়েছেন। অর্থ সাহায্যও পেয়েছেন অনেকের কাছ থেকে। তা দিয়েই তৈরি হয়েছে অনাথ আশ্রম। এভাবেই আশ্রয়হীন এক ভিখারিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন ভারতের ‘অনাথ জননী’।
জেডএ/জেআইএম