মুরসিকে কৌশলে হত্যা করা হয়েছে?

আহমেদ সজীব
আহমেদ সজীব আহমেদ সজীব , সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৯:৪১ পিএম, ১৮ জুন ২০১৯

বিচার চলাকালীন আদালতেই মৃত্যুবরণ করেছেন মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলতে নারাজ তার দল মুসলিম ব্রাদারহুডসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তারা এই ‘হত্যাকাণ্ডের’ নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করছে। তারা বলছে, পরিকল্পিতভাবেই মুরসিকে হত্যা করা হয়েছে।

২০১৩ সালে সেনা অভ্যূত্থানের মাধ্যমে পদচ্যুত হন ৬৭ বছর বয়সী মুরসি। গত সোমবার তিনি আদালত চত্বরে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দি মুরসির মৃত্যুর পর গোপনে তার দাফনও সম্পন্ন হয়েছে।

তার এই মৃত্যু নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করছেন। বিশেষ করে আদলতকে গতকাল বলা তার একটি কথা এই সন্দেহকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। তিনি আদালতকে সতর্ক করে বলেছিলেন যে, তার কাছে ‘অনেক গোপন তথ্য’ আছে যা তিনি প্রকাশ করতে পারেন। মার্কিন বার্তা সংস্থা এপিকে মামলার এক বিচারক এই তথ্য জানান।

আরও পড়ুন>> গোপনেই মুরসির দাফন সম্পন্ন

এই কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি আচমকা মাটিতে পড়ে যান। জানা যায়, ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন তিনি। তার এমন মৃত্যু মানবাধিকার রেকর্ড ইস্যুতে মিসর সরকারকে চাপের মুখে ফেলবে। কেননা দেশটির কারাগারে মানবাধিকার পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। দেশটিতে লাখ লাখ ইসলামী আন্দোলনের কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট কারাগারে আটক রয়েছেন।

কায়রোতে মুরসির পরিবারের কিছু সদস্যের উপস্থিতিতে গোপনে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তার একজন আইনজীবী মঙ্গলবার সকালে সাংবাদিকদের এই কথা জানান। মুরসি তার দেয়া শেষ বক্তব্যেও জানান যে, তিনিই হলেন মিসরের বৈধ প্রেসিডেন্ট।

মুরসির দল মুসলিম ব্রাদারহুড দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে মুরসিকে হত্যার অভিযোগ তুলছে। দলটি বলছে, দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে চরম শোচনীয় অবস্থার মধ্যে মুরসিকে আটকে রাখার মাধ্যমেই সরকার কৌশলে তাকে (মুরসি) হত্যা করেছে। মুরসির মৃত্যুর পর দেয়া এক বিবৃতিতে এই হত্যকাণ্ডের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে দলটি। গোটা বিশ্বে মিসরের যত দূতাবাস আছে সেগুলোতে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানিয়েছে তারা।

২০১১ সালে দেশটিতে বিক্ষোভ শুরু হলে নির্বাচনের মাধ্যমে হলে তখনকার প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে সরিয়ে ক্ষমতায় বসেন মুরসি। কিন্তু তার মাত্র এক বছরের মধ্যে মুরসির বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। ওই সময় সামরিক অভ্যূত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে বন্দী করা হয়। তখন থেকেই তার বিচার চলছে।

আরও পড়ুন>> মুরসির মৃত্যুতে জাতিসংঘের তদন্ত দাবি

মুরসিকে গ্রেফতার করে তৎকালীন সেনাপ্রধান আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসেন। তখন থেকে তিনিই ক্ষমতায় রয়েছেন। গত বছর নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার গঠন করেন তিনি। তবে সেটি ছিল পাতানো নির্বাচন।

২০১৩ সালের জুলাইতে ক্ষমতাচ্যুৎ হন মুরসি। মুরসিকে গ্রেফতার করার পর সিসি মুরসির দল মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভূক্ত করে দেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেন। এরপর দলের লাখো কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাবন্দি করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাবিষয়ক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক সারাহ লিহ হুইটসন এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘মুরসির মৃত্যু ভয়ানক হলেও তা অনুমেয় ছিল।’তিনি এই মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটনের আহ্বান জানিয়েছেন।

নিউইয়র্কভিত্তিক এই মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, ‘বছরের পর বছর কারাগারে মুরসিকে অনেকটা সময় নিঃসঙ্গ রাখা, পরিবার ও আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে না দেয়া, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা ইত্যাদির কারণে মুরসির মৃত্যু হয়েছে।’

আরও পড়ুন>> মুরসির মৃত্যুতে যা বললেন এরদোয়ান

কারাগার জুড়ে বন্দীদের ব্যাপক হারে উপেক্ষা করাসহ মিসরে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্ত চেয়েছে সংস্থাটি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও মুরসির মৃত্যুর তদন্ত করতে মিসর কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

মোহাম্মদ সুদান নামে মুসলিম ব্রাদারহুডের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ইউরো নিউজকে বলেছেন, ‘মুরসির কোনো রকম ঔষধ নেয়া থেকে নিষেধাজ্ঞা ছিল, কেউ তাকে দেখতে যেতে পারতো না এবং তার শারীরিক অবস্থার ব্যাপারে খুব কম তথ্য জানা যেত। এটা একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’

মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক অঙ্গ সংগঠন দ্য ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি মুরসির মৃত্যুকে ‘হত্যা’ বলে দাবি করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান মুরসির মৃত্যুর জন্য মিসরের ‘অত্যাচারী শাসকদের’ দায়ী করেছেন এবং মুরসিকে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

২০১৭ সালে মুরসির একটি মামলা শুনানির ভিডিও ফাঁস হয়। যেখানে মুরসি বলছেন, তিনি আদালতের কাছ সম্পূর্ণভাবে আইসলোটেড হয়ে আছেন। তিনি তার প্রতিরক্ষা দলের কাউকে দেখতে কিংবা কারও কথা শুনতে পারেন না। তিনি যখন আলোতে আসেন তখন তার চোখ জ্বালা করে। কিছুই দেখতে পান না।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সহকারী পরিচালক মেগডালেনা মুঘরাবি বলেন, ‘মুরসির মৃত্যুর মাধ্যমে মারাত্মক যে প্রশ্নটি উঠেছে সেটি হলো কারাবন্দি অবস্থায় তার চিকিৎসা নিয়ে।’

তিনি মিসর কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তারা মুরসির মৃত্যু নিয়ে নিরপেক্ষ, বিস্তারিত ও স্বচ্ছ তদন্ত করতে হবে। এছাড়াও তার কারাবন্দি জীবনের অবস্থা এবং তাকে চিকিৎসা সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার বিষয়টিও তদন্ত করার আহ্বান জানান তিনি।

এসএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।