এক সময়ের শত্রু এখন স্বামী-স্ত্রী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:৪২ এএম, ১৫ জুন ২০১৯

গৌরি মালার আর রোশান জায়াথিলাকে তাদের ১১ মাস বয়সী মেয়ের সঙ্গে খেলা করতে দেখলে মনে হবে না যে মাত্র ১০ বছর আগেও একে অপরের শত্রু ছিলেন তারা।

২৬ বছর বয়সী গৌরি ছিলেন শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগার্সদের শিশু যোদ্ধা। তাদের মতে, যারা লড়াই করতো রোশানের মতো মানুষদের দ্বারা সৃষ্ট অত্যাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।

তিনি বলেন, ‘সিংহলীদের দেখা বা তাদের সঙ্গে কথা বলিনি আমি। আমরা ভাবতাম তারা খারাপ মানুষ এবং আমাদের হত্যা করবে।’

আর রোশানের জন্য বিদ্রোহীরা ছিল ঘৃণিত শত্রু। ২৬ বছর ধরে চলা যুদ্ধে যাদের বোমা হামলা প্রাণ কেড়ে নেয় নিষ্পাপ মানুষের।

‘আমরা একে অপরকে শত্রু ভাবতাম,’ বলছিলেন ২৯ বছর বয়সী রোশান।

তিনি বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা সুখী দম্পতি। আমাদের মেয়ে আমাদের ভালোবাসার প্রতীক।’

তাহলে কোন পরিবর্তন তাদের এক হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল? তারা এখন নিজেদের একটা বাড়ি তৈরি, একটা গাড়ি কেনা আর ছোট্ট সেনুলি চামালকাকে স্কুলে পাঠানোর স্বপ্ন দেখে।

শ্রীলঙ্কায় সহিংসতা শুরু হয় ১৯৮৩ সালে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলীদের একটা অংশের মধ্যে বাড়তি জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার ক্ষোভে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলা চালিয়ে ১৩ সেনাকে হত্যা করে।

এই ঘটনা তামিলবিরোধী দাঙ্গার জন্ম দেয়। যাতে প্রাণ হারায় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীটির কয়েক’শ সদস্য।

গৌরির জীবনে যুদ্ধ ছিল নিয়মিত বিষয়ের মতোই। তবে এটা স্থায়ীভাবে বদলে যায় ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে। যখন গৌরি জানতে পারে, তার বড় ভাই শুভ্রমানিয়াম কান্নান ট্রাক্টর চালানোর সময় গোলার আঘাতে আহত হয়েছেন।

ভাঙা মন নিয়ে বড় ভাইকে খুঁজতে গিয়ে বিদ্রোহীদের হাতে অপহৃত হন তিনি। ১৬ বছর বয়সী গৌরিকে এক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠায় তারা।

‘আমি দেখলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ’, বলেন গৌরি।

তিনি বলেন, ‘আমার এক বান্ধবী বোমার আঘাতে আহত হয়। আমরা তাকে ওঠানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে একটি সায়ানাইড ক্যাপসুল চিবিয়ে খেয়ে আত্মহত্যা করে। কারণ, তার ক্ষতগুলো এতই মারাত্মক ছিল যে বেঁচে থাকাটা তার কাছে নিরর্থক ছিল।’

‘আমাদের গোসল এবং খাবারের কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। এক সময় আমার মনে হতে লাগলো যে বেঁচে থেকে লাভ কী?’

২০০৪ সালে ১৪ বছর বয়সে যুদ্ধ তার থাবা বিস্তার করে রোশানের জীবনে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী আর সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকার মাঝে অবস্থিত ভাবুনিয়া জেলায় রোশানের পারিবারিক গ্রামে হিন্দু নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে আঘাত হানে বিদ্রোহীদের ছোড়া একটি বোমা। এর পরপরই বোমা হামলায় সামরিক-বেসামরিক মানুষদের মৃত্যুর ক্ষোভে বাবা আর চাচাত ভাই-বোনদের মতোই সরকারি নিরাপত্তা বিভাগে যোগ দেন রোশান।

‘আমরা প্রায় প্রতিদিনই হামলার খবর শুনতাম’,- বলেন রোশান।

তিনি জানান, সংঘাতে নিজের এক ভাইকে হারান তিনি। ‘মানুষ ভীত ছিল। মারা পরার ভয়ে এক সঙ্গে কোথাও ঘুরতেও যেতো না কেউ।’

২০০৯ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রায় এক লাখ মানুষ প্রাণ হারায় এই সহিংসতায়। ২০১৫ সালে এক প্রতিবেদনে, অন্যায় হত্যাকাণ্ডের জন্য দুপক্ষকেই দায়ী করে জাতিসংঘ।

এতে বলা হয়, নির্যাতন আর ধর্ষণের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনী। আর বয়স্ক ও শিশুদের জোর করে যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেছে বিদ্রোহীরা।

প্রায় এক মাস যুদ্ধ করেছে গৌরি। হৃদযন্ত্রে ত্রুটি থাকার কারণে গৌরিকে মুক্ত করে দেন তার দলনেতা। এর পরেই শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে গৌরি।

সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচিতে পাঠানো আরও অনেক বিদ্রোহীদের সঙ্গে ছিলেন তিনি। বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব থাকলেও সিংহলীদের সঙ্গে মিশে গৌরি অনুভব করে যে, তারাও ‘মানুষ’। এরপর সরকারি নিরাপত্তা বিভাগে যোগ দেন তিনি।

উত্তরাঞ্চলে কিছু খামার প্রতিষ্ঠা করেছিল সরকার। আর উদয়নকাট্টুতে এরকমই একটি খামারে পরিচয় হয় গৌরির হবু স্বামীর সঙ্গে।

২০১৩ সালে সেখানে নিয়োগ পান গৌরি। আর সেখানে এক বছর আগে থেকেই কাজ করছিলেন রোশান। তবে তামিল-ভাষী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় বেশ ঝামেলায় ছিলেন তিনি।

রোশানের দোভাষী হিসেবে কাজ করতেন গৌরি। যে তার জীবন বদলে দিয়েছিলেন। গৌরি বলেন, ‘তিনি নিশ্চয়ই একা হয়ে পড়েছিলেন। আমি চাইতাম তিনি যেন ভাল থাকেন। তাই বাসা থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে আসতাম।’

খুব দ্রুতই তারা পরস্পরের প্রতি অনুভূতি বুঝতে পারেন। ‘আমি তাকে বলেছিলাম, আমি তাকে তার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাস ’,- গৌরি বলেন।

রোশান বলেন, ‘আমি যখন ছুটিতে যেতাম যখন গৌরি কান্নাকাটি করতো। সে নিশ্চিত হতে চাইতো যে টিকে থাকার মতো পর্যাপ্ত অর্থ আমার কাছে আছে কি না।’

নিজেদের সম্পর্কের কথা প্রকাশ করলে প্রচলিত নানা কুসংস্কারের মুখে পড়তে হয় তাদের। রোশানের এক আত্মীয় বলেন, ‘সিংহলী অনেক মেয়ে থাকতে তামিল কোন মেয়ের পেছনে কেন পড়ে আছিস?’

রোশানের মা তাদের বিয়ের বিপক্ষে ছিলেন। সাবেক তামিল টাইগার যোদ্ধা গৌরির বোনও বিপক্ষে ছিলেন। তার ধারণা ছিল সিংহলী কাউকে বিয়ে করলে সম্প্রদায় থেকে বের করে দেয়া হবে গৌরিকে। আর তার স্বামীও তাকে মারপিট করবে।

তারা বলেন, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দেখে দুই পরিবার তাদের মেনে নিতে রাজি হয়।

‘ধীরে ধীরে সব কিছু ঠিক হয়ে যায়’,- গৌরি বলেন। এমনকি রোশানের মাও মৃত্যুর আগে সেনুলি চামালকার আগমনে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলেন।

‘আমাদের ছোট্ট ফেরেশতা আমাদের আরও বেশি কাছে এনেছে’,- তিনি বলেন। এখন গৌরির পরিবারের সঙ্গে থাকেন এই দম্পতি। গৌরি বলেন, রোশান আমার বোনের ‘সবচেয়ে পছন্দের দুলাভাই’ হয়েছেন।

২০১৪ সালে বিয়ে করেন এই দম্পতি। সেনুলি চামালকারকে হিন্দু আর বৌদ্ধ দুই ধরনের মন্দিরেই নিয়ে যান তারা। তাদের কাছে বিভক্তি এখন শুধুই অতীত।

যাই হোক, ইস্টার সানডে হামলায় আড়াই’শ মানুষের প্রাণহানি এবং এর জেরে মুসলিম বিরোধী মনোভাব দেশটিকে নতুন করে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন এই দম্পতি।

গৌরি বলেন, ‘যেকোনো যুদ্ধে কোনো এক পক্ষের মানুষ মারা যায় না। ধর্ম আর বিশ্বাসের বাইরেও অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় যুদ্ধ।’

‘আমরা আরেকটা যুদ্ধ চাই না,’- গৌরি বলেন।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

জেডএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।