যেভাবে কেটে যাচ্ছে কেনিয়ায় সমকামীদের জীবন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:২০ এএম, ২৬ মে ২০১৯

‘প্রথম যেদিন বাবা-মাকে জানালাম, আমি একজন সমকামী, সেদিন থেকেই তারা আমাকে অস্বীকার করতে শুরু করল। আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো। পরিবার আমার সঙ্গে পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। এমতাবস্থায় বিশাল এক অবসাদের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আমার কোনো কোনো বন্ধু আমাকে তাদের বাসায় থাকতে দিতে চাইছিল, কিন্তু তাদের পরিবারের আপত্তির কারণে তারা পারছিল না। অন্য কয়েকজন আমাকে থাকতে সুযোগ করে দিতে চাইছিল, কিন্তু সেজন্য তারা আমাকে তাদের বিছানায় পেতে চাইত।’

কথাগুলো কেনিয়ার নাইরোবির বাসিন্দা অ্যালেক্সার (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি দেশটির সমকামীদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সমকামিতার বিরুদ্ধে কেনিয়ায় মানুষের মনোভাব অত্যন্ত কঠোর। ফলে অ্যালেক্সের মতো মানুষদের প্রতিদিনকার জীবনযাপন খুব কঠিন হয়ে ওঠে। বিদ্যালয়ে তাকে যেমন নানা ধরনের কটু মন্তব্যের শিকার হতে হয়, তেমনি সামাজিকভাবেও অনেক নিগ্রহের মধ্যে পড়েন। কেনিয়ার পুরুষ বা নারী সমকামী, বাইসেক্সুয়াল বা ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের আরও অনেক সদস্যের মতো অ্যালেক্সও হাইকোর্টের দিকে অধীর হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন, যাতে করে দেশটির সমকামিতা বিষয়ে বিদ্যমান আইনটি বাতিল করা হয়। ওই আইনে সমকামিতাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। তবে কেনিয়ার উচ্চ আদালত ওই আইন বহাল থাকার পক্ষেই রায় দিয়েছেন।

সাতাশ বছরের সমকামী যুবক অ্যালেক্সা নিজেকে ‘নারী’ ভূমিকায় দেখতে ভালোবাসেন। এখন একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপের সঙ্গে কাজ করছেন তিনি।

তিনি বলছেন, ‘মানুষের মনোভাব আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে। আমার দুই বোন ও এক ভাই রয়েছে। তারা আমার সঙ্গে এখন নিয়মিত কথা বলে। আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে আমার বোনরা। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, সেই আশঙ্কায় তারা আমাকে মানতে রাজি হন না। তবে তাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। আমি শুধু চাই, কোনো একদিন তারা আমাকে মেনে নেবেন।’
কেনিয়ায় সমকামিতাকে বৈধতা দেয়ার জন্য বছরের পর বছর সমকামীরা আন্দোলন করছেন। তবে খ্রিষ্টান ও মুসলিম গ্রুপগুলো এর বিরোধিতা করে আসছে। তাদের ভাষ্য, সমকামিতাকে আইনগত বৈধতা দেয়া হলে তা আফ্রিকান সংস্কৃতির বাইরে চলে যাবে। তারা বলছেন, অনেক আফ্রিকান ভাষায় সমকামিতার জন্য কোনো শব্দ পর্যন্ত নেই।

এমন এক কঠিন পরিবেশের মধ্য দিয়ে চলতে হয় কেনিয়ায় অ্যালেক্সার মতো সমকামীদের। অ্যালেক্সা বলেন, ‘প্রকাশ্য যে কোনো স্থানে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হতো। অনেক রেস্তোরাঁয় আমাকে খাবার দেয়া হতো না, জনসমাগমের স্থানগুলোতে লোকজন আমাকে এড়িয়ে চলত।’

ক্রিসমাসের মতো বিশেষ উৎসবগুলোয় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চান অ্যালেক্স। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের পরিবারের বাইরে বসবাস করি। কিন্তু আমরা পরিবারের মধ্যেই বাস করতে চাই।’

তবে সবার অবস্থা অ্যালেক্সার মতো না। শিল্পী ও সমঅধিকারের পক্ষে আন্দোলনকারী কায়িরা মাউরিশি ব্যক্তিগতভাবে কোনো হয়রানির শিকার হননি বলে জানান। বরং তার পিতা-মাতা তাকে মেনে নিয়েছেন এবং তার নিজের জীবনযাপনে উৎসাহ দিয়েছেন।

‘আমার মনে হয়না যে, পুরো সমাজের সমকামীদের নিয়ে বিরূপ মনোভাব রয়েছে। আমাদের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এটা বিশাল কোনো ব্যাপার না। কিন্তু অন্তত একবার রক্ষণশীল একজন নেতা কোত্থেকে এসে হুমকি তৈরি করেছিলেন’-বলেন কারিয়া।

তবে নিজে ব্যক্তিগতভাবে কোনো ধরনের প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন না হলেও তার বন্ধুদের কাছ থেকে অনেক ভীতিকর কাহিনী শুনেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এমন অনেককে জানি, যাদের ভালো করার নাম দিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে।’

কেনিয়ায় নারী সমকামীদের যৌনতার ব্যাপারটিকে ‘সুস্থ’ করে তোলার জন্য, পুরুষদের দ্বারা ধর্ষণ করানো হয়। বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে ২০০৮ সালে, যখন দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক আন্তর্জাতিক ফুটবলার ইডি সিমেলানকে গণধর্ষণ, মারধর ও হত্যার জন্য ছুরিকাঘাত করা হয়।

নারী সমকামীরা ধর্ষণের শিকার হলেও বিচারের জন্য পুলিশের কাছে যেতে ভয় পান। এর কারণ হিসেবে কায়িরা মাউরিশি বলেন, ‘তারা যদি পুলিশের কাছে যান, তাহলে হয়তো তাদের গ্রেফতার করা হবে-এমন ভয় তাদের মধ্যে কাজ করে।’

কেনিয়ায় বর্তমান আইন অনুযায়ী, সমকামিতার দায়ে দোষী একজন ব্যক্তির ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছেন, এই আইনের খুবই কম প্রয়োগ হচ্ছে।

‘গত ১০ বছরে এ রকম মাত্র দুটি সাজা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে’- বলছেন এই ক্যাম্পেইন গ্রুপের কর্মকর্তা নিলা ঘোষাল।

এলজিবিটি (সমকামী এবং ব্যতিক্রমী লিঙ্গের মানুষ যারা) গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজন প্রায়শ পুলিশ ও অন্যান্য গোষ্ঠীর কাছে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় সমকামীদের প্রতি মানুষের বিরূপ আচরণের প্রবণতা বেশি।

কেনিয়ার একটি এনজিও, ন্যাশনাল গে অ্যান্ড লেসবিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বলছে, ২০১৪ সাল থেকে শুধুমাত্র তাদের প্রতিষ্ঠান থেকেই ১৫০০ ঘটনায় আইনি সহায়তা দেয়া হয়েছে।

সহিংসতার আশঙ্কায় অনেক সমকামী নারী-পুরুষ দেশ থেকে পালিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোয় আশ্রয় নিয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন কেনেথ মাচারিয়া, যিনি যুক্তরাজ্যে শরণার্থীর আশ্রয় চেয়েছেন। তিনি এখন ‘সমকামীবান্ধব’ ব্রিস্টল বাইসন্স রাগবি দলে খেলেন।

তবে আফ্রিকার অনেক দেশে সমকামীদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আসছে। এ বছরের শুরুর দিকে অ্যাঙ্গোলায় তাদের ঔপনিবেশিক আমলের আইনটি বাতিল করে দিয়েছে। বোতসোয়ানার হাইকোর্ট জুন মাস নাগাদ এ বিষয়ে রায় দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে চাদ হেঁটেছে উল্টো পথে। ২০১৪ সালে দেশটি বিশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রেখে একটি আইন অনুমোদন দিয়েছে।

আফ্রিকার ৫৪টি দেশের মধ্যে ৩৪টি দেশে সমকামিতার অপরাধে কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। বিশ্বের অন্তত ৭০টি দেশে এ রকম আইন রয়েছে, যাদের অর্ধেক দেশই একসময় ব্রিটিশ কলোনি ছিল।

আফ্রিকার অন্যান্য দেশের মতো কেনিয়ায় সমকামীদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে। কেনিয়ায় এখন অনেক নারী পুরুষ নিজেদের সমকামী পরিচয়ের ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে বলেন। কিন্তু তাদের ওপর হামলার বা সহিংসতার সম্ভাবনা এখনো কমেনি।

এ ব্যাপারে তুমাইনি (ছদ্মনাম) নামের একজন বিবিসিকে বলেন, ‘আমি বারবার ভাবি, কোন কাপড় পরব এবং আমি কী করব। অন্য কেউ আমার সম্পর্কে কী ভাববে-এসব। আমি কখনোই জানি না যে, কার সঙ্গে আমি দেখা করতে যাচ্ছি। মানুষজন আমার পেছনে ফিসফাস করে। এটা যদি আমার বন্ধুর ব্যাপারে করে, তাহলে সেটায় আমার আপত্তি আছে। নতুন কোনো স্থানে গেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি।’

তিনি সমকামী জানার পর তার অনেক বন্ধু ও স্বজন তাকে পরিত্যাগ করেছেন। তুমাইনি বলেন, ‘এটার ভীতিকর দিকটা অনেক বড়, সেটা পরিবর্তন করা অনেক কঠিন। তবে তরুণ প্রজন্ম এখন অনেক বেশি খোলামেলা হয়েছে। এমনকি যারা সমকামিতাকে সমর্থন করেন না, তারাও আমাদের বন্ধু এবং একজন মানুষ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা যায়।’

এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।