পাকিস্তানে এত শিশুর এইচআইভিতে আক্রান্তের কারণ কী?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:০২ এএম, ২২ মে ২০১৯

পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় ছোট শহর রাত্তো ডিরোতে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম নজরে আসে যে কিছু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেসময় কিছুসংখ্যক উদ্বিগ্ন বাবা-মা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন এবং জানালেন যে, তাদের ছোট ছোট শিশুদের জ্বর কিছুতেই কমছে না। সপ্তাহের ব্যবধানে আরও অনেক শিশু একই ধরনের অসুস্থতা নিয়ে হাজির।

হতবাক চিকিৎসক ইমরান আরবানি। তিনি শিশুদের রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠালেন। রিপোর্ট ফিরে আসার পর দেখা গেল- যেমনটা তিনি আশঙ্কা করেছিলেন তা-ই।

অসুস্থ শিশুরা এইচআইভি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত, কিন্তু তা কীভাবে, কেন ঘটেছে? কেউ জানে না।

গত ২৪ এপ্রিলের মধ্যে ১৫টি শিশু এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে, যদিও তাদের কারও বাবা-মায়ের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। বিবিসিকে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসকরা।

তবে এটা ছিল কেবল ঘটনার শুরু।

সিন্ধু প্রদেশে এ নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লে বহু উদ্বিগ্ন বাবা মা বিশেষভাবে প্রস্তুত করা ক্যাম্পে ভিড় জমালে গতমাসে ৬০৭ জনের বেশি মানুষের এইচআইভি সংক্রমণ নির্ণয় করা হয়, যাদের ৭৫ শতাংশ শিশু।

তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অঞ্চলটিতে এটাই প্রথম এ ধরনের প্রাদুর্ভাব নয়। ২০১৬ সালে সিন্ধু প্রদেশের লারকানায় গুজবের কারণে হাজার হাজার মানুষের প্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষা করা হয়।

সিন্ধুর এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুসারে, সেসময় ১,৫২১ জন এইচআইভি পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হন।

সংক্রমিতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল পুরুষ, সেসময় এর পেছনে কারণ হিসেবে ছিল সেই অঞ্চলের যৌনকর্মীরা, যারা ছিলেন প্রধানত তৃতীয় লিঙ্গের এবং তাদের ৩২ জন এইডস বহন করছেন বলে জানা যায়।

এ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর লারকানায় আগন্তুকদের প্রবেশের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, যেখানে পাকিস্তানে পতিতাবৃত্তিতে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যৌনকর্মীরা অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে তাদের ব্যবসা চালাতে সক্ষম হয়েছিল।

সিন্ধুর এইডস নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এসএসিপি) নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডক্টর আসাদ মেমন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এই ভাইরাস (এইডস) অতি ঝুঁকিপূর্ণ গ্রুপের সদস্যদের (তৃতীয় লিঙ্গ এবং নারী যৌনকর্মী) দ্বারা পরিবাহিত হয়েছে এবং পরে স্থানীয় হাতুড়ে ডাক্তারদের অসতর্কতার কারণে তা অন্যান্য রোগীদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটিয়েছে।

হাতুড়ে ডাক্তার বলতে যারা কোনোধরনের যোগ্যতা ছাড়াই চিকিৎসা কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তাদের বোঝান তিনি। পাকিস্তানের মতো দেশে বিশেষ করে প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার অনেক মানুষ প্রায়ই দক্ষ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে এ ধরনের হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য ছুটে যান।

কারণ, টাকা-পয়সা কম লাগে। সহজে পাওয়া যায় এবং রোগীদের দেয়ার মতো প্রচুর সময় রয়েছে তাদের হাতে।

ডক্টর ফাতিমা মীর, আগা খান ইউনিভার্সিটি হসপিটালের হয়ে কাজ করেন এবং শিশুদের মধ্যে এইডস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।

তিনি বর্তমানে রাত্তো ডিরোতে স্বেচ্ছায় কাজ করছেন। তিনি সম্মত হলেন যে অবহেলাপূর্ণ চিকিৎসাসেবা অধিকাংশ শিশুর সংক্রমণ এবং ২০১৬ সালের প্রাদুর্ভাবের পেছনে দায়ী।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘তিনটি উপায়ে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ ঘটতে পারে। হয়তো এই ভাইরাস বহনকারী মায়ের দুধ পানের মাধ্যমে, রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে, কিংবা সংক্রামিত অস্ত্রোপচার সরঞ্জাম বা সিরিঞ্জের মাধ্যমে।’

তার অভিজ্ঞতা অনুসারে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মা এইচআইভি পরীক্ষায় নেগেটিভ দেখা যায় এবং কিছু শিশুর রক্ত সঞ্চালনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বাকি যে ব্যাখ্যাটি এসেছে তা হলো স্থানীয় ক্লিনিকগুলোতে একই সিরিঞ্জ একাধিক রোগীর শরীরে পুশ করা হয়।

কর্মকর্তারাও একমত হলেন। প্রদেশজুড়ে প্রায় ৫০০ অনিয়ন্ত্রিত ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ তেমনই জানাচ্ছে।

স্থানীয় একজন শিশু বিশেষজ্ঞ ডক্টর মুজফফর ঘাংগ্রুকে সিরিঞ্জের মাধ্যমে এইডস ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এদিকে পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি এই্চআইভি সংক্রমের শিকার এলাকা সিন্ধু প্রদেশের কর্মকর্তারা এ প্রাদুর্ভাবের কারণ খুঁজতে তদন্ত শুরু করেছে।

কিন্তু তা তো আর যারা এরইমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে তাদের জীবনে কোনো হেরফের ঘটাতে পারবে না। তাদের পুরো জীবনভরই এর প্রভাব থাকবে।

রাত্তো ডিরোর হাসপাতাল ক্যাম্পে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১৮ হাজার ৪১৮ জনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। কমপক্ষে ৬০৭ জনের পজিটিভ বলে শনাক্ত হয়েছে। শিশুদের মধ্যে এক মাস থেকে ১৫ বছর বয়সীরাও রয়েছে। ফলে শত শত বাবা-মাকে চরম মূল্য চোকাতে হচ্ছে- সন্তানের চিকিৎসা এবং তাদের রোজকার টিকে থাকার লড়াই- দুটোর জন্যই।

একজন মা বলছিলেন যার তিন বছর বয়সী সন্তান এইচআইভি আক্রান্ত ‘লারকানায় বড়দের জন্য ওষুধপত্র সাধারণত পাওয়া যায় (স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে) কিন্তু শিশুদের ওষুধের জন্য যেতে হয় করাচি। এর মানে হলো প্রতিটি ভ্রমণে হাজার হাজার রুপি খরচ করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী দিনমজুর, ফলে দীর্ঘদিন এটার ব্যয় নির্বাহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।’

সূত্র : বিবিসি বাংলা

জেডএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।