নাগরিক থেকে শরণার্থী


প্রকাশিত: ০২:০৮ পিএম, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বাস্তুহারা করে দিচ্ছে অসংখ্য নাগরিককে। সর্বস্ব খুইয়ে, স্বজনহারা হয়ে ঘর ছাড়ছেন তারা। তাদেরই একজন বাদের ইউসুফ। কীভাবে সিরিয়া ছেড়ে গ্রিস, অস্ট্রিয়া হয়ে শেষমেশ জার্মানিতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পেলেন, তারই রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন সিরিয়ার স্কুলশিক্ষক ইউসুফ।

একে তো সমুদ্রে বিশাল ঢেউ। তার উপর পালাতে চাওয়া মানুষের ভিড়! দুইয়ে মিলে টলমল নৌকার অনেকগুলোই ডুবেছে সাগরের জলে! আর এর মধ্যেই গ্রেফতার করা হয় আমাকে। তারপর তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে জেলে পুরে রাখা হয়- বলেন ইউসুফ।

এরপর ইউসুফ বলতে থাকেন তার সেই কষ্টের কথা- শেষমেশ কোনোরকমে  গ্রিসের একটা দ্বীপে এসে পৌঁছেছিলাম। স্থানীয় থানায় পৌঁছতে প্রায় তিন ঘণ্টা হাঁটতে হয়েছিল। পৌঁছে দেখি, আমার আগেই সেখানে দাঁড়িয়ে অসংখ্য শরণার্থী। কি বিশাল লাইন! পুলিশ যাবতীয় তথ্য নিয়েছিল। তারপর নির্দেশ দেয়, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরা যেন গ্রিস ছেড়ে চলে যাই! সেক্ষেত্রে আমাদের প্রথম যেতে হবে অ্যাথেন্স। সেখান থেকে বাসে ম্যাসিডোনিয়ার সীমান্ত। একটা ছোট জাহাজে কোনো রকমে জায়গা পেয়েছিলাম। অ্যাথেন্স যেতে জনপ্রতি ভাড়া লেগেছিল ৪৭ ইউরো!

Migrants-2

অ্যাথেন্স থেকে যে বাসে আমরা ম্যাসিডোনিয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেটিকে হঠাৎ পুলিশ তাড়া করে। প্রথমে বুঝিনি। পরে জেনেছি, বাসচালক ভুল পথে যাচ্ছিলেন। পুলিশ আমাদের সবাইকে থানায় নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি, সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টায় সিরিয়ার অসংখ্য শরণার্থীকে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে।

এর পর প্রায় ৪৮ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। শুনেছি সার্বিয়ার পরিস্থিতি বেশ ভাল। আমরা সার্বিয়ার ট্রেনে উঠে বসি। সেখানে পৌঁছে দেখি, শরণার্থীদের সাহায্য করতে সীমান্তে প্রচুর অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে। উদ্বাস্তুদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিল পানীয় জল এবং খাবার। এরপর আমরা অনেক হেঁটেছি। কতক্ষণ, তার আর হিসেব রাখিনি। শেষে একটা মসজিদে পৌঁছেছিলাম। রাতটা কাটিয়েছিলাম সেখানেই। পরে যখন বেলগ্রেড পৌঁছাই, হোটেলে থাকার জন্য সেখানে দিতে হয়েছিল ৩০ ইউরো। সেখান থেকে হাঙ্গেরি সীমান্ত গিয়েছিলাম। দালালরা সেখানে আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল বোধহয়! তাদেরই একজন আমাকে বলেছিল, তুমি যদি আমার সঙ্গে বুদাপেস্ট যেতে চাও তবে এক হাজার ইউরো দিতে হবে।

এরপর অনন্ত পথ হেঁটেছি! ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধুই হাঁটা আর হাঁটা। ঘন জঙ্গল পথে সেই হাঁটার শেষে আমাদের জন্য একটি গাড়ি রাখা ছিল। তাতে করেই পৌঁছেছিলাম রাজধানীতে। সেখান পৌঁছে যে হোটেলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়, সেটি চালান এক জাপানি ভদ্রমহিলা। আমাদের দেখেই বলেছিলেন, আমার এখানে কোনো ঘরই খালি নেই। তবে, হোটেল লাগোয়া ওই বাগানে রাতে শুতে পারেন। সেক্ষেত্রে প্রত্যেককে ১০ ইউরো করে দিতে হবে!

Migrants-3

দ্বিতীয় দিন সেই দালাল এসে জানায়, তুমি কি জার্মানি যেতে চাও! তা হলে আরও ৬০০ ইউরো দিতে হবে। সেক্ষেত্রে আমাদের নাকি একটি অত্যাধুনিক বাসে করে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হবে! রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ আমরা জার্মানিতেই থিতু হতে চাইছিলাম। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছে সে দেশে শরণার্থী হওয়ার আবেদন জানাতে পারাটাই তখন মূল লক্ষ্য। আর রাজি হওয়ার পর থেকে বাসের জন্য তর সইছিল না যেন! অবশেষে যখন বাস এল, দেখলাম তার একটি আসনও খালি নেই। কিন্তু, আমাদের তো যেতেই হবে। তাই বাসের মেঝেতেই বসে পড়েছিলাম।

প্রথমেই চোখ গিয়েছিল চালকের দিকে। ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের উপর তো হবেই! তার উপরে তিনি যে মদ্যপ অবস্থায় রয়েছেন, সেটা বুঝতে এক মিনিটও সময় লাগেনি। এমনকী, তিনি যে ঠিকমতো রাস্তাও চেনেন না সেটাও ধরা পড়ে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। আর এই পরিস্থিতিতে যা হওয়ার, তাই হয়েছিল।  দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আমাদের বাস। কাজেই অস্ট্রিয়াতেই বাসটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই!

এরপর জার্মানির জন্য একটা ট্রেনে চড়েছিলাম বটে, কিন্তু পুলিশ গ্রেফতার করে আমাদের। অস্ট্রিয়া পুলিশের হাতে তিন দিন জেলবন্দি অবস্থাতেই কাটাতে হয়। পরে তারা দুটি প্রস্তাব দেয় আমাদের। ভুল বললাম, প্রস্তাব নয়, নির্দেশ! হয় তাদের কাছে আঙুলের ছাপ দিতে হবে, নয়তো সে দেশেই শরণার্থী হওয়ার আবেদন জানাতে হবে। আমি দুটির কোনোটিতেই সম্মত হতে পারিনি। কাজেই ওদের প্রস্তাব পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। ওরাও আর দেরি করেনি। পেছনে এক প্রকার লাথি মেরেই আমাদের হাঙ্গেরির সীমান্তে পাঠিয়ে দেয়।

Migrants-4

সেখানে পৌঁছেও দেখি দালালের অভাব নেই। তাদের একজনকে ধরে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলাম কোনো রকমে। সেই গাড়িতে উঠে পরিচয় হয়েছিল আরও এক সিরীয় পরিবারের সঙ্গে। তাঁরাও জার্মানি যাচ্ছিলেন। দালালটি আমার কাছ থেকে নিশ্চিত এবং নিরাপদ সফরের জন্য ৬০০ ইউরো অতিরিক্ত নিয়েছিল।

এখন আমি জার্মানির একটি শরণার্থী শিবিরে রয়েছি। আমার সঙ্গে অসংখ্য সিরীয়, ইরাকি, আফগানি, পাকিস্তানি নাগরিক, শরণার্থী রয়েছেন। এই শিবিরে দিনে তিনবার আমাদের খেতে দেওয়া হয়। অন্য একটি শরণার্থী শিবিরে আমাদের খুব শিগগিরই স্থানান্তর করা হবে। আপাতত তারই অপেক্ষায় আছি।

পাশাপাশি, শরণার্থী হতে চেয়ে আবেদন করতে হবে বলে এখানকার আদালত কবে ডেকে পাঠায় তার জন্যও দিন গুনছি। তবে, একটা কথা! জার্মানরা সত্যিই ভীষণ উদার এবং মানবিক। আমার এই ইউরোপ সফরে যতগুলি দেশ অতিক্রম করেছি তার মধ্যে তো বটেই।

এসআইএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।