আক্রান্ত সৌদি জাহাজ : মাথাব্যথা ট্রাম্পের, ইরানে হামলার পায়তারা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৭:১৭ পিএম, ১৪ মে ২০১৯
আক্রান্ত সৌদি জাহাজ : মাথাব্যথা ট্রাম্পের

সৌদি আরবে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপকূলীয় অঞ্চলে সৌদি আরবের তেলবাহী জাহাজে হামলায় জড়িতদের শনাক্তের পর ‘যুদ্ধের ধাঁচে যুক্তিসঙ্গত জবাব’ দেয়া উচিত ওয়াশিংটনের।

এদিকে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত দেশটির সরকারি এক কর্মকর্তা বলেছেন, ওয়াশিংটনের হাতে বিশেষ কোনো প্রমাণ না থাকলেও আমিরাতে সৌদি জাহাজে হামলার ‘মূল সন্দেহভাজন’ হিসেবে ইরানকে দেখা হচ্ছে। তবে ইরান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, ইসরায়েলি দুর্বৃত্তরা এই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।

মঙ্গলবার সৌদিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন আবিজাইদ বলেন, কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে সেটা বোঝার জন্য আমাদের একটি তদন্ত দরকার। তারপর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধের ধাঁচে যুক্তিসঙ্গত জবাব’ দিতে হবে। ‘সংঘাতে জড়ানো ইরানের আগ্রহের বিষয় নয়, এটা আমাদেরও আগ্রহের বিষয় নয়; এটা সৌদি আরবেরও আগ্রহের বিষয় নয়।’

রোববার আমিরাতের বন্দরনগরী ফুজাইরার উপকূলীয় এলাকায় সৌদি আরবের চারটি তেলবাহী বাণিজ্যিক জাহাজে গুপ্ত হামলা হয়। ইরান এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে পৃথককারী হরমুজ প্রণালীর কাছে অবস্থিত ফুজাইরা বন্দরে সৌদির জাহাজে হামলার ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য।

সৌদির চিরবৈরী আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানকে হামলার ‘মূল সন্দেহভাজন’ হিসেবে দাবি করে দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে হামলায় কারা জড়িত সে ব্যাপারে কোনো তথ্যই দেয়নি আরব আমিরাত।
কিন্তু থেমে নেই যুক্তরাষ্ট্র।

তেহরানকে পরোক্ষভাবে ওয়াশিংটন দায়ী করলেও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সৌদি জাহাজে হামলার ঘটনাকে ‘উদ্বেগজনক এবং ভীতিকর’ বলে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে, হামলায় তেলবাহী জাহাজ সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে স্বীকার করলেও হামলার পেছনে কারা জড়িত সে ব্যাপারে সৌদি আরবও মন্তব্য করেনি।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি ও নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বাকযুদ্ধ চলছে ইরানের। ২০১৫ সালে ইরানের স্বাক্ষরিত ছয় বিশ্ব শক্তির পারমাণবিক চুক্তি থেকে গত বছর বেরিয়ে যাওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় তেহরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ওয়াশিংটন বলছে, তেহরানের তেল রফতানি শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে চায় তারা।

সৌদির জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে মার্কিন সমুদ্রবিষয়ক প্রশাসন বলেছিল, মধ্যপ্রাচ্যের পানিপথ ব্যবহার করে চলাচলকারী তেল ট্যাঙ্কার-সহ মার্কিন বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালাতে পারে ইরান। তেহরান বলছে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকে তারা হুমকি নয়, টার্গেট মনে করে।

কোনো ধরনের প্রমাণ সরবরাহ করতে না পারলেও ওয়াশিংটনের এক কর্মকর্তা বলেছেন, মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রাথমিক অনুসন্ধানে সৌদির জাহাজ উড়িয়ে দিতে ইরান এবং ইরানি মিত্রদের জড়িত থাকার আলামত মিলেছে।

মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম বহর ফুজাইরা বন্দর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়মিত টহল দেয়। এই বহরের কর্মকর্তারা সৌদির জাহাজে হামলার ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই অঞ্চলে ইরান এবং তার মিত্ররা সমুদ্রে মর্মান্তিক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে কয়েকদিন আগে সতর্ক করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের সঙ্গে ব্যাপক উত্তেজনার মাঝে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস আব্রাহাম লিঙ্কন, বোমারু বিমান বি-৫২ মোতায়েন করেছে।

চলমান উত্তেজনার কারণে মঙ্গলবার স্পেন পারস্য উপসাগরে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বহরে মোতায়েনকৃত একটি রণতরী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, পারস্য উপসাগর ও হরমুজ প্রণালীতে টহলরত মার্কিন নৌ-বহরের সঙ্গে স্পেনের রণতরী মেন্দেজ নুনেজ আর টহল দেবে না। পারস্য উপসাগরে মার্কিন বহরে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের একমাত্র রণতরী হিসেবে টহলে অংশ নিতো ২১৫ নাবিক ও বোমারু বিমানবাহী স্পেনের মেন্দেজ নুনেজ।

মধ্যপ্রাচ্যের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় জাতিসংঘ এই অঞ্চলের শান্তির জন্য সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটির উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, ‘এই অঞ্চলের শান্তি ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সমুদ্রে অবাধ চলাচলের জন্য সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানো উচিত।’

সোমবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। বৈঠকে ইরানের কাছ থেকে পাওয়া হুমকির ব্যাপারে আলোচনা করেন তিনি। বৈঠকের পর মাইক পম্পেও সিএনবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা ভুল হিসেব-নিকেশ করতে যাচ্ছি না। আমাদের লক্ষ্য যুদ্ধ নয়। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, ইরানের নেতৃত্বের আচরণে পরিবর্তন আনা।’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসার জন্য মঙ্গলবার মস্কো পৌঁছেছেন পম্পেও।

ফুজাইরা বন্দরে সৌদির জাহাজে হামলায় ইরান কোনো ভূমিকা রেখেছে কি-না কিংবা পররাষ্ট্র মন্ত্রী পম্পেও তেহরানকে দায়ী বললেও এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তেহরানে নিযুক্ত মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি ব্রেইন হুক। তবে তিনি বলেছেন, হামলার ঘটনা তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছে আরব আমিরাত।

আমিরাতের একটি দৈনিক কঠোর সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। এই দৈনিকটি মঙ্গলবার এক সম্পাদকীয়তে হামলা পরবর্তী পরিস্থিতি এবং জবাব দেয়ার বিষয়ে ঠান্ডা মাথায় অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। সামান্য ভুলের কারণে যাতে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঝুঁকিতে না পড়ে সেটি মাথায় রেখে বিষয়টির তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে।

আবু ধাবিভিত্তিক দ্য ন্যাশনাল বলছে, ‘উদ্বেগজনক এই ঘটনায় এখনো বিস্তারিত কোনো কিছুই জানা যায়নি। এ জন্য অবশ্যই মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে এবং এই পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়; সেটি নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে।’

দুবাইয়ের আরেক রাষ্ট্রীয় দৈনিক গালফ নিউজ বলছে, ‘দুর্বৃত্তদের অবশ্যই মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।’ সৌদি আরবের জ্বালানি মন্ত্রী বলেছেন, বৈশ্বিক অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে এই হামলা হয়েছে। বিশ্বের তেল চাহিদার এক পঞ্চমাংশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অন্যান্য অঞ্চলে যায় হরমুজ প্রণালী হয়ে। সংকীর্ণ এই পানিপথ ইরান এবং আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে পৃথক করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনায় চিরবৈরী প্রতিদ্বন্দ্বীরা কি চান? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চাওয়া বড় পরিসরের অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে ইরানকে বাধ্য করা। কিন্তু ইরান ট্রাম্পের এই চাওয়াকে পাত্তা না দিয়ে বলছে, তেহরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা পারমাণবিক চুক্তির শর্তের পরিপন্থী। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার কিংবা শিথিল করা না হলে তারা পুনরায় পারমাণবিক অস্ত্র ও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প জোরেসোরে শুরু করবে।

একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে হুমকির বদলে টার্গেট হিসেবে দেখার দাবি করেছে ইরান। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সব সামরিক ঘাঁটি ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে বলেও জানিয়েছে দেশটির বিপ্লবী গার্ড বাহিনী। তারা বলেছে, সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে তারা প্রবল উপায়ে তার জবাব দেবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মাথায়ও আঘাত হানার হুমকি এসেছে এই বাহিনীর প্রধানের কাছ থেকে।

ইরানের বিপ্লবী এই গার্ড বাহিনীকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে কালো তালিকাভূক্ত করেছে ওয়াশিংটন। ইরানকে চলাচলে বাধা দেয়া হলে এই বাহিনী হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছে।

সূত্র : এপি, রয়টার্স, সিএনবিসি।

এসআইএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।