রাত থেকেই আতঙ্ক। সকাল হতে সেটা আরও বেশি করে চেপে বসে মনে। পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলের ধারে জলদা, চাঁদপুর এলাকার মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের মনে কেবল একটাই চিন্তা, ‘ঘরটা আস্ত পাব তো?’
শুক্রবার বিকাল নাগাদ জলদা সাইক্লোন রেসকিউ সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে মনে জাগা এমন আশঙ্কার কথা জানান আয়লার দগদগে ক্ষত বহন করা সুশীল দলুই। এমন বক্তব্য সেখানে আশ্রয় নেয়া শত শত জেলেরও।
দিঘা জাতীয় সড়ক থেকে শঙ্করপুর হয়ে যে রাস্তা তাজপুরে পৌঁছায়, রামনগর ব্লকের সেই রাস্তার ধারেই জলদা আর চাঁদপুর। সমুদ্রের পাড় ঘেঁসে রাস্তা। তার ধারেই একের পর এক গ্রাম। গতকাল রাত থেকেই হাওয়ার তেজ যে বাড়ছে, তা টের পাচ্ছিলেন এলাকার মানুষ। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল সমুদ্রের গর্জনও।
শুক্রবার সকালে যখন ফণী আছড়ে পড়ে পুরীর কাছে, তখন থেকেই যেন আরও ফুঁসে উঠতে শুরু করে সমুদ্র। পরিস্থিতি যে হাতের বাইরে যেতে পারে, তা আঁচ করতে পেরেছিলেন দিন-রাত সমুদ্র আর নোনাজলের সঙ্গে ঘর করা মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের এই মানুষরা।
বছর পঞ্চাশের সুশীল দলুই আর দেরি করেননি। সমুদ্রের মতিগতি দেখেই গরু-বাছুরসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে হাজির হন কয়েক বছর আগে তৈরি হওয়া সাইক্লোন রিলিফ সেন্টারে। স্থানীয়দের কাছে যা আয়লা সেন্টার নামে পরিচিত।
বৃহস্পতিবার জলদা সাইক্লোন রেসকিউ সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সুশীল দলুই বলেন, সেবার বাঁধ ছাপিয়ে দৈত্যের মতো ঢেউ ঢুকে পড়েছিল গ্রামে। কিছু বোঝার আগেই জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল গোটা গ্রাম। কোনো মতে পেছনের ঝাউ-বাবলার জঙ্গলে গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন।
সেই স্মৃতি আর ফিরে আসুক চান না তিনি। চান না সুশীলের মতো গ্রামের বাকিরাও। তাই সকাল বেলা হাওয়ার গতি আর দরিয়ার ঢেউয়ের মতিগতি দেখেই গ্রামের প্রায় ছয়শ পরিবার সকাল ৯টার মধ্যেই সমুদ্রের ধার ঘেঁসে তৈরি হওয়া ‘আয়লা সেন্টারে’ চলে এসেছেন।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা প্রশাসক দেবব্রত দাস বলেন, ‘গোটা জেলায় একশোরও বেশি এমন সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। সমুদ্রের ধার বরাবর শুধু এই মৎস্যজীবী গ্রামগুলোর জন্যই আছে মোট ১৪টি আয়লা সেন্টার।
চাঁদপুরের বাসিন্দা ঝন্টু দলুই। সমুদ্রের পাড়ে বাঁধের জন্য দেয়া শালখুঁটি আর বোল্ডার দেখিয়ে বলেন, জল ওঠা শুরু হলে এ বোল্ডার আর শালখুঁটি ১০ সেকেন্ডও দাঁড়াতে পারবে না। জোয়ারের সময়ই জল বাঁধ ছাপিয়ে যায়। এমন ঝড় হলে তো কথাই নেই। সেজন্য আমরা কেউ ঝুঁকি নিতে পারিনি।
সুশীলের মতোই আইলার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন সন্ধ্যা দলুই। জলদা রেসকিউ সেন্টারের দোতলার ঘরে বসে বলেন, আগে তো প্রাণে বাঁচি। ফণীর সামান্য টোকাতেই মাটিতে মিশে যাবে টালির চালের মাটির ঘর। প্রাণে বাঁচলে আবারও মাথা তুলে দাঁড়ানো যাবে।
জেলা প্রশাসনের দাবি, সন্ধ্যা না হতেই আয়লা সেন্টারে আশ্রয় নেয়া মানুষের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পর্যাপ্ত ত্রাণও মজুদ করা হচ্ছে। জেলার পুলিশ সুপার ভি সলোমন নিশাকুমার বলেন, এখন পর্যন্ত ১৫,০০০ গ্রামবাসীকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মকর্তারাও। ইতোমধ্যে এনডিআরএফের অতিরিক্ত দুটি দল দিঘা সংলগ্ন এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে।
উপকূলবর্তী এলাকা ঘুরে দেখছেন জেলা প্রশাসক পার্থ ঘোষ নিজেও। এদিকে দফায় দফায় বাড়ছে বৃষ্টির তীব্রতা। সূত্র- আনন্দবাজার।
এমএআর/এমএস