কট্টর জাতীয়তাবাদের খোলসে জয়ের স্বপ্ন দেখা মোদি সফল হবেন?
সাইফুজ্জামান সুমন সাইফুজ্জামান সুমন , সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৫২ পিএম, ১০ এপ্রিল ২০১৯
কট্টর জাতীয়তাবাদের পাটাতনে ভর করে আবারো ক্ষমতায় আসার স্বপ্নে বিভোর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু জাতীয়তাবাদের ধোঁয়া তুলে সহজ জয়ের সমীকরণ প্রত্যাশার চেয়ে একটু কঠিনই হয়ে পড়ছে। আর এতে প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করতে পারে আয় কমে যাওয়া দেশটির প্রান্তিক কৃষক ও বেকার তরুণদের ভোট। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক এই দেশটির উচ্চকক্ষ লোকসভার ১৭তম নির্বাচন শুরু হচ্ছে বৃহস্পতিবার।
নির্বাচনের পূর্বাভাসগুলো বলছে, নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জোট পার্লামেন্টে সামান্য ব্যবধানে জয়ী হবে। কিন্তু তার এই জয় গত পাঁচ বছর আগের জয়ের চেয়ে একটু কঠিনই হবে। কারণ ওই নির্বাচনে তিনি ভারতকে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত করার অঙ্গীকার করেছিলেন; যা পূরণে মোদি ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবি বিরোধীদের।
নরেন্দ্র মোদির সরকার কোটি কোটি বেকারের কর্মসংস্থান তৈরিতে অক্ষম, উৎপাদিত পণ্যের দরপতনে হতাশ কৃষক। ফলে মোদি যে আলো দেখিয়ে পৃথিবীর দ্রুততম ক্রমবর্ধমান প্রধান অর্থনীতির দেশ গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাতে ভাটা পড়েছে।
আরও পড়ুন : মোদি নাকি রাহুল, কে আসছে ভারতের ক্ষমতায়?
উত্তরপ্রদেশের ইক্ষু শ্রমিকদের উৎপাদন থেকে শুরু করে দক্ষিণের ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মুখ থুবড়ে পড়েছেন। কারণ তারা চাষাবাদ ও ব্যবসার জন্য নতুন যেসব চাহিদা তৈরি হচ্ছে সেগুলোর যোগান পাচ্ছেন না। মোদির জীবনী ও কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী লেখক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় বলেন, আমরা যেমনটা কল্পনা করেছিলাম, তারচেয়েও বেশি জমেছে নির্বাচন। দেশজুড়েই মানুষের মাঝে এক ধরনের ক্ষোভ ও ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে।
রাহুল গান্ধীর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের কাছে তিনটি প্রদেশের নির্বাচনে বিজেপি হেরে যাওয়ার পর গত ডিসেম্বরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ঢোল পেটান মোদি। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে চিরশত্রু ভারতের সঙ্গে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে মোদির জাতীয়তাবাদের ঢেউয়ে ইতিবাচক হাওয়া লাগে। এই সময় তিনি নিজেকে জাতীয় নিরাপত্তার একজন ধারক হিসেবে হাজির করেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল হিসেবে তুলে ধরেন। এমনকি তাদের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের উবার চালক শিব চন্দ্র রয় রয়টার্সকে বলেন, মোদি তার দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না করায় দেশের জনগণ অসন্তুষ্ট। প্রত্যেকেই বলছে, দেশে চাকরি নেই, প্রত্যেক জায়গায় কৃষকরা রীতিমতো লড়াই করছেন। কিন্তু পাকিস্তান ইস্যুতে আমরা এখন বিভ্রান্ত। অনেকেই মনে করেন, এই ইস্যুতেই মোদিকে আমাদের ভোট দেয়া উচিত; এটা এক ধরনের জাতীয় সমস্যা।
আরও পড়ুন : প্রথম দফায় ভোট হচ্ছে যেসব রাজ্যে
গত ফেব্রুয়ারিতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় প্রাণঘাতী হামলার দায় স্বীকার করার পর পাকিস্তানের ভেতরে জঙ্গিগোষ্ঠী জয়েশ-ই-মোহাম্মদের ঘাঁটিতে বিমান হামলা চালানোর নির্দেশ দেন মোদি। ১৯৭১ সালের পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায় ভারত।
এই অভিযানের একদিন পর পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তান আকাশসীমা লঙ্ঘন করে ভারতের ভেতরে যুদ্ধবিমান নিয়ে অনুপ্রবেশ করে। এ নিয়ে দুই দেশ একে অপরকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা-পাল্টা হামলা চালানোর হুমকিও দেয়। যদিও পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমা বিশ্বের হস্তক্ষেপে পাক-ভারত উত্তেজনা কমে যায়।
এতে নিজেকে জয়ী দাবি করেন মোদি; কাশ্মীরে আবারো জঙ্গি হামলা হলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেন তিনি। হামলা পরবর্তী উদ্বেগ ও উত্তেজনা তৈরি হলেও মোদি সেই উদ্বেগে কর্ণপাত করেননি। চলতি সপ্তাহে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের একটি প্রদেশের সমাবেশে অংশ নিয়ে বিরোধী দল কংগ্রেসকে উদ্দেশে করে মোদি বলেন, সন্ত্রাসবাদের শক্তির বিরুদ্ধে ভারত যখন শক্তিশালী ব্যবস্থা নেয়, তখন কেন তাদের গা জ্বলে।
পুলিশ বলছে, মঙ্গলবার বিজেপি সংশ্লিষ্ট কট্টর হিন্দুত্ববাদী একটি গোষ্ঠীর এক আঞ্চলিক নেতা ও তার দেহরক্ষী বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। দেশটির উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ জম্মু-কাশ্মীরের একটি হাসপাতালে ওই বন্দুকধারী হামলা চালায়। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে বিজেপির উদ্বেগের মাঝেই বন্দুক হামলার এ ঘটনা ঘটে।
আরও পড়ুন : হিটলার থাকলে গলায় দড়ি দিতেন : মোদিকে কটাক্ষ মমতার
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইরত গোষ্ঠীগুলো বৃহস্পতিবারের প্রথম দফা নির্বাচনে ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকতে বাসিন্দাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। মঙ্গলবার পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ ছত্তিশগড়েও হামলার শিকার হয়েছে বিজেপি। বামপন্থী মাওবাদী বিদ্রোহীদের পুঁতে রাখা বোমার বিস্ফোরণে বিজেপির আঞ্চলিক এক বিধায়ক-সহ পাঁচজন নিহত হয়েছেন।
ভারতের এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রধান রাহুল গান্ধীর বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রকে ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে বলা হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে তিনি প্রথমবারের মতো দলটির পদে আসীন হন। মোদির ভঙ্গুর অর্থনৈতিক প্রতিশ্রুতির বিপরীতে কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচারণার চালক হিসেবে কাজ করতে চান প্রিয়াঙ্কা।
ভারতে জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৩০ কোটি। এর মধ্যে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ। দারিদ্র সমূলে উৎপাটনের লক্ষ্যে রাহুল গান্ধী এই দরিদ্র পরিবারগুলোকে প্রত্যেক মাসে ৬ হাজার রূপি করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আরও পড়ুন : মোদিকেই ফের ক্ষমতায় দেখতে চান পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান
নয়াদিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভলপিং সোসাইটির কর্মকর্তা সঞ্জয় কুমার বলেন, কৃষকদের দুর্দশা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা ও বেকারত্বের মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনে ভোটারদের মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে কংগ্রেস।
ভারতের এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন প্রায় ৯০ কোটি ভোটার। ১১ এপ্রিল (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু সাত দফার এই নির্বাচন শেষ হবে আগামী ১৯ মে। ১০ লাখের বেশি ভোটকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত ভোটের চূড়ান্ত ফল আগামী ২৩ মে ঘোষণা করা হবে।
কংগ্রেস বলছে, হিন্দুরা আগে; এই মতাদর্শের ডামোডোল পিটিয়ে প্রত্যেক বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মাঝে বিজেপি এখন আতঙ্ক। সংখ্যালঘু মুসলিমরা এখন ভীত। তবে বিজেপি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
এসআইএস/এমএস