নারীর স্তন নিয়ে গল্প আর ছবি প্রকাশ করছেন ভারতীয় নারী শিল্পী
নারী শরীরের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও আকর্ষণীয় অংশ স্তন। আর এ স্পর্শকাতর অংশ নিয়ে ছবি ও গল্প প্রকাশ করতে চান ভারতীয় নারী শিল্পী ইন্দু হরিকুমার। যে কোনো নারীকে জিজ্ঞেস করুন, পুরুষ নারী শরীরের যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি ভাবেন সেই জিনিসটি কী? তাহলে অকপটে তারা স্বীকার করবেন-স্তন। তবে ভারতীয় নারী শিল্পী ইন্দু হরিকুমারকে যদি এ প্রশ্ন করেন, তাহলে তিনি এর একটা অন্যরকম জবাব দেবেন।
গত কয়েক মাস ধরে ইন্দু হরিকুমার একটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন-যার নাম দেয়া হয়েছে আইডেন্টিটি বা আত্মপরিচয়। তবে এই আইডেন্টিটির বানানের শেষ অংশটা লেখা হয়েছে দুটো ‘টি’ দিয়ে। যার অর্থ ‘খুবই পরিষ্কার’।
তার এ উদ্যোগ সম্পর্কে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে ইন্দু বলেন, ‘প্রায় এক বছর আগে তিনি ইনস্টাগ্রামে একজনের সঙ্গে গল্প করছিলেন। গল্পের বিষয় ছিল স্তন। সেই নারী বলছিলেন, তিনি যখন কোথাও যান, কোনো ঘরে ঢোকেন তখন পুরুষদের কী প্রতিক্রিয়া হয় সে সম্পর্কে। তার উত্তর-পুরুষরা তার বৃহৎ স্তন ছাড়া যেন আর কিছুই দেখতে পান না।’
ওই নারীর কথার জবাব দিতে গিয়ে ইন্দু বলেন, ‘আমার নিজের ক্ষেত্রে উল্টো অভিজ্ঞতা হয়েছে। কারণ অল্প বয়েসে আমি নিজের বুকের গঠনের জন্য সবসময়ই হীনমন্যতায় ভুগতাম।’ এরপর তিনি বলেন, ‘তখন আমরা দুজন (তিনি ও ওই নারী) মিলে ঠিক করলাম আমরা এ নিয়েই একটা প্রকল্প শুরু করব যেখানে নারীরাই এ বিষয়ে তাদের কথা বলবেন। অনেক নারীই এতে আগ্রহ দেখালেন এবং আমরা প্রকল্পে হাত দিলাম।’
প্রকল্পের নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের নাম হিসেবে দুটো “টি” দিয়ে আইডেন্টিটি লেখার ভাবনাটা এসেছিল আমাদের এক বন্ধুর মাথা থেকে। আমাদের মনে হলো-এটাই উপযুক্ত নাম।’
মুম্বাইয়ের বাসিন্দা ইন্দু মূলত ইনস্টাগ্রামেই কাজ করেন। তিনি জানুয়ারি মাসে ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট দেন। এতে নারীদের তাদের স্তন নিয়ে ব্যক্তিগত গল্প শেয়ার করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। উদ্দেশ্য পৃথিবীতে মানবদেহের সবচেয়ে আলোচিত, প্রদর্শিত এবং আকাঙ্খিত অংশটি নিয়ে নারীরা যেন তাদের আনন্দ, বেদনা এবং কদাচিৎ অপমানের শিকার হবার গল্প শেয়ার করতে পারেন। গল্পের সঙ্গে তাদের ছবিও দিতে বলা হয়, যে যেভাবে দিতে চান।
হরিকুমার বলেন, ‘ওই পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে যে সাড়া পাই তা ছিল অভূতপূর্ব। কারণ সব নারীরই তার বক্ষ নিয়ে একটা-না-একটা গল্প আছে এবং এর আকৃতি ও গঠন তার আত্মপরিচয়েরও একটা অংশ হয়ে যায়।’
ইন্দুর নিজের গল্পও কম চিত্তাকর্ষক নয়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন টিনএজার তখন আমি ছিলাম ভীষণ রোগা, হাড়-জিরজিরে। আমি সবসময় ভাবতাম কবে আমার বুক একজন পরিণত নারীর মতো হবে। দেখতাম টিনএজ ছেলেরা সেই সব মেয়েদের প্রতিই আকৃষ্ট হয় যাদের স্তন সুগঠিত। আর যাদের বুক আমার মতো সমান ছিল তারা ভাবতো তাদেরকে কেউ কোনো দিন ভালোবাসবে না।’
তিনি ভাবতেন তার শরীরের নিশ্চয়ই কোনো একটা সমস্যা আছে আর তিনি ভালোবাসার উপযুক্ত নন। এ জন্য তিনি কিছু ক্ষতিকর সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন এই ভেবে যে, যা পাওয়া যায় তা নিয়ে নেয়াই ভালো।
ইন্দুর বয়স এখন মধ্য-তিরিশের কোঠায়। এখন তিনি মনে করেন তিনি একটি সুন্দর দেহের অধিকারী কিন্তু এখানে পৌঁছাতে তার অনেক সময় লেগেছে। এজন্য তিনি যখন বুক নিয়ে মনঃকষ্টে-ভোগা কোনো নারীর গল্প পড়েন, তখন তিনি তাকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন।
নারীদের মধ্যে স্তনের আকৃতি নিয়ে অসন্তুষ্টি দুভাবেই কাজ করে। ব্রিটেনে ৩৮৪ জন নারীর ওপর চালানো এক জরিপে দেখা যায়, তাদের ৪৪ শতাংশ চান যদি এর আকৃতি আরও বড় হতো! আর ৩১ শতাংশ চান এর আকৃতি যদি ছোট হতো!
গল্পের সঙ্গে মিল রেখে ই্ন্দু হরিকুমারের আঁকা একটি ছবি
তবে ছোট স্তনের আকার নিয়ে কষ্টে ভোগেন এমন নারী যেমন আছেন, তেমনি এর আকৃতি বড় বলে তা নিয়ে লজ্জা ও নানা অসুবিধার শিকার হন এমন নারীও আছে বলে জানিয়েছেন হরিকুমার।
ইন্দু হরিকুমারের ইনস্টাগ্রাম প্রকল্পে কেউ কেউ লিখেছেন, ‘যারা মনে করেন যে বড় স্তন আকর্ষণীয় আসলে তা এক নিষ্ঠুর মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়। আমি এর জন্য দৌড়াতে পারি না, জিমে যেতে পারি না, যোগব্যায়াম করতে পারি না। এখন আমার সন্তান বুকের দুধ খাচ্ছে। এখন তো আরও অসুবিধার সময়।’
তবে এমন অনেক নারীও আছেন যারা তাদের নিজ দেহ নিয়ে গর্ব ও আনন্দ বোধ করেন। একজন নারী লিখেছেন, ‘তিনি চান তার গল্পের সঙ্গে ছবিটাতে যেন তাকে শয়নকক্ষের মধ্যে বসিয়ে আঁকা হয়। কারণ পুরুষের মনের ওপর তার স্তনের যে অভিঘাত হয় সে সম্পর্কে তিনি সচেতন এবং তিনি জানেন যে তার শক্তি কতখানি।’
ইন্দু হরিকুমারের এ প্রকল্প এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। কারণ ভারতের সমাজ এখনো প্রধানত রক্ষণশীল এবং মেয়েরা শালীন পোশাক পরবেন-এটাই প্রত্যাশা করা হয়। ভারতে বড় শহরগুলোর বাইরে পোশাকের গলার দিকটা থাকে উঁচু আর নিচের দিকে তা হাঁটুর নিচে পর্যন্ত নামে। ব্লাউজের ভেতর থেকে ব্রা-র স্ট্র্যাপ একটু বেরিয়ে থাকলেও নারীকে হয়তো তিরস্কারের শিকার হতে হয়। খুব দুঃসাহসী নারী না হলে কেউ তার স্তনের মাঝখানের ভাঁজ দেখান না।
কিন্তু তারপরও এই প্রকল্পের ডাকবাক্স খোলার পর থেকে ইন্দু প্রচুর ই-মেইল ও ছবি পাচ্ছেন। দুমাসে প্রায় ৬০টি গল্প পেয়েছেন তিনি। তার মধ্যে ১৯টির জন্য ছবি এঁকে শেষ করেছেন। এসব ছবি গল্পগুলোর সঙ্গে প্রকাশিত হবে কিন্তু তাতে তাদের আসল চেহারার সঙ্গে কোনো মিল থাকবে না। তারা কে কোথা থেকে লিখেছেন তারও কোনো ইঙ্গিত থাকবে না।
ভারতের ছোট-বড় অনেক শহর থেকেই তিনি চিঠি পাচ্ছেন। যারা লিখছেন তাদের বয়স ১৮ থেকে ৫০-এর মধ্যে। গোপনীয়তা রক্ষার নিশ্চয়তা পেয়েই তারা মন খুলে তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত অনুভূতি নিয়ে লিখতে পারছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
এসআর/এমকেএইচ