পাইলট অভিনন্দনই এখন পাকিস্তানের ‘ট্রাম্প কার্ড’
পাকিস্তানে ভারতীয় একটি বিমান ভূপাতিতের পর সেই বিমানের পাইলট অভিনন্দন বর্তমানকে আটক করা হয়েছে। পাক-ভারত উত্তেজনায় আপাতত দুই দেশের জন্য দুই ধরনের নিয়ামক হিসেবে হাজির হয়েছেন ভারতীয় ওই পাইলট। ভারতীয়দের কাছে ‘জাতীয় বীর’র খেতাবে ভূষিত হচ্ছেন তিনি, অন্যদিকে ইসলামাবাদের কাছে তিনি এই মুহূর্তে ‘ট্রাম্প কার্ড’। সম্ভবত যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যাওয়া চিরবৈরী দুই দেশকে আবারো লাগাম টানার মূল চাবিকাঠি হচ্ছেন তিনি।
পাকিস্তানি একটি ভিডিওতে বলা হয়, ভারতীয় বিমানবাহিনীর এই সদস্যের নাম অভিনন্দন বর্তমান। তিনি বিমান বাহিনীর একজন উইং কমান্ডার। ভূপাতিত বিমান থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রথমে উত্তেজিত জনতা তাকে মারপিট ও জিজ্ঞাসাবাদ করে। এই ভিডিও উভয় দেশেই ভাইরাল হয়েছে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে উদ্ধারের পর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এ নিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রধারী চিরশত্রু দুই দেশের সম্পর্কের আড়ালের মানবিক একটি দিকও ফুটে উঠেছে।
বুধবার ভারত নিশ্চিত করেছে, তাদের একটি বিমান ভূপাতিত এবং একজন পাইলট দায়িত্ব পালনের সময় নিখোঁজ হয়েছেন। কাশ্মীরের আকাশসীমায় দুই দেশের যুদ্ধবিমান প্রবেশ ও পাল্টাপাল্টি ভূপাতিত করার দাবি নিয়ে কথার লড়াইয়ের পর প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে পাইলট নিখোঁজের তথ্য নিশ্চিত করে নয়াদিল্লি।
এসব ঘটনা পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে চরম উত্তেজনা তৈরি করেছে। অতীতে এই দু’টি দেশ দু’বার যুদ্ধ করেছে। এছাড়া কাশ্মীর ইস্যুতে প্রতিনিয়ত প্রাণঘাতী বিচ্ছিন্ন সংঘাতে জড়িয়েছে। প্রতিশোধ এবং পাল্টা আক্রমণের এক চক্রে ঢুকে পড়েছে উভয় দেশ; যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উইং কমান্ডার অভিনন্দনের বেশ কিছু ভিডিও প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। এসব ভিডিও ‘কুরুচিপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছে নয়াদিল্লি। তবে অভিনন্দনকে নিরাপদে ফেরত আনতে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন সর্ব-স্তরের ভারতীয়রা।
তবে তাকে উত্তেজিত জনতার হাত থেকে উদ্ধার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার ঘটনায় ভারতীয়রাও প্রশংসা করছেন। এটাকে পাক সেনাবাহিনীর মানবিকতা এবং সৌজন্যতা হিসেবে অভিহিত করছেন ভারতীয়রা।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ভারতীয় এই পাইলটকে ভূপাতিত বিমান থেকে টেনে-হেঁচড়ে বের করে এনে মারপিট করছেন উত্তেজিত কাশ্মীরিরা। পরে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা চিৎকার করে মারধর থামাতে বলেন এবং তাকে উদ্ধার করেন। পরে অন্য এক ভিডিওতে পাক সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় এই পাইলট তার নাম অভিনন্দন বলে জানান।
অপর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, উইং কমান্ডার অভিনন্দনের হাতে চায়ের কাপ, রক্তাক্ত মুখ ধুয়ে ফেলা হয়েছে এবং তাকে শান্ত দেখাচ্ছে। এই ভিডিওতে তিনি পাকিস্তানের উদ্ধারকারী সেনাসদস্যদের ভদ্র মানুষ বলে মন্তব্য করেন। চায়ের প্রশংসা করে বলেন ‘চমৎকার’।
‘আমি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছেও এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করবো এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি আমি খুবই বিমোহিত।’ তবে তাকে এসব বলতে বাধ্য করা হয়েছে কি-না সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। পাকিস্তানের বেশিরভাগ টেলিভিশন চ্যানেলে অভিনন্দনের এসব মন্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। এমনকি দেশটির অনেক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় অভিনন্দনের ছবি ছাপানো হয়।
দেশটির ইংরেজি দৈনিক এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের প্রথম পাতায় একটি সংবাদের শিরোনাম করা হয়, ‘উত্তেজিত জনতার হাত থেকে রক্ষা করায় পাক-সেনার প্রশংসা করল ভারতীয় পাইলট।’ কিন্তু ভারতের গণমাধ্যমের এসব ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ হয়নি। ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, তারা পাইলট অভিনন্দনের ছবি না ছাপানোর ব্যাপারে একটি সচেতনতামূলক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে খুব দ্রুত ট্রেন্ড হয়েছে অভিনন্দনকে নিয়ে হ্যাশট্যাগে করা টুইট; ‘অভিনন্দনকে ফেরত দাও’ (#GivebackAbhinandan), ‘অভিনন্দন আমাদের বীর’ (#Abhinandanmyhero)। বলিউড তারকা ইমরান হাশমি টুইটে লিখেছেন, ‘প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এমন শান্ত ও প্রাণোচ্ছল! আমাদের সাহসী পাইলট অভিনন্দন বর্তমানের জন্য প্রার্থনা।’
অভিনন্দন এখন পাকিস্তানের হাতিয়ার
অভিনন্দন বলেছেন, তিনি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দা। স্থানীয় গণমাধ্যমের দাবি, অভিনন্দনের বাবা ভারতীয় বিমানবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় ভারতীয় আধা-সামরিক বাহিনীর গাড়ি বহরে জঙ্গি হামলায় ৪০ জওয়ানের প্রাণহানির পর পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে যুদ্ধবিমান থেকে অভিযান চালায় ভারতীয় বিমানবাহিনী।
এই অভিযানের একদিন পর বুধবার দুই দেশের আকাশসীমায় পাল্টাপাল্টি অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। পাকিস্তান বলছে, তারা ভারতীয় বিমানবাহিনীর দুটি বিমান ভূপাতিত এবং একজন পাইলটকে আটক করেছে। ভারতের দাবি, তারাও পাকিস্তানের একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে জানায়, পাকিস্তানি অনুপ্রবেশ ঠেকানোর সময় ভারতীয় একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান ও পাইলট নিখোঁজ হয়েছে। বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের দৈনিক ডন বলছে, পাইলট অভিনন্দন জানতেন না বিমানটি কোন দেশের ভূখণ্ডে ভূপাতিত হচ্ছে। তবে সেই সময় উত্তেজিত জনতা দেখে তিনি আতঙ্ক তৈরির জন্য পিস্তল থেকে গুলিবর্ষণ করেছেন। পরে তিনি পায়ে হেঁটে এগিয়ে যান এবং তার কাছে থাকা নথিপত্র দেখান।
বিশ্লেষকরা বলছে, তাকে আটক করা হয়েছে। এখন তার ভাগ্যে যা ঘটবে; তার ওপর নির্ভর করছে কয়েক দশকের চির-প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রতিবেশির এ যাবৎকালের উত্তেজনা কোন দিকে মোড় নেয়। অভিনন্দনকে আটকের খবর প্রকাশের পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতকে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন।
নয়াদিল্লিতে ফরেইন পলিসির ফেলো ধ্রুব জয়শঙ্কর বলেন, অভিনন্দনকে আটকের ঘটনা দুই দেশের মাঝে উত্তেজনা প্রশমনের পথ তৈরি করতে পারে। কিন্তু পাইলটের সঙ্গে কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করা হলে সেটি ভারতে প্রচুর ক্ষোভ তৈরি এবং যে সঙ্কট চলছে সেটির বিস্তৃতি ঘটতে পারে।
ভারতের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল আরএস সুজলানা বলেন, পাকিস্তান আটক পাইলটকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এমনকি তাদের দাবি-দাওয়ার মাত্রাও বাড়াতে পারে। তবে পাকিস্তান যদি তাকে সৌজন্যতাবোধ দেখিয়ে ছেড়ে দেয়, তাহলে সেটি এই অঞ্চলে শান্তি আনতে সহায়তা করবে।
এসআইএস/এমকেএইচ