যেভাবে এল প্লাস্টিক চালের গুজব

সাইফুজ্জামান সুমন
সাইফুজ্জামান সুমন সাইফুজ্জামান সুমন , সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:০৩ পিএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা গাইবান্ধার স্থানীয় একটি বাজারে প্লাস্টিকের চাল পাওয়ার গুজব গণমাধ্যমের খবরে ভাসছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, এর আগে ভারতের তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ, হায়দরাবাদ-সহ আফ্রিকার কিছু দেশেও একই ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু আসলেই কী প্লাস্টিকের চাল তৈরি অথবা বাজারে বিক্রি সম্ভব, নাকি এটি শুধুই গুজব।

তাহলে ফিরে যাওয়া যাক ২০১৭ সালে। আফ্রিকার দেশ সেনেগাল, ঘানা এবং গাম্বিয়ার স্থানীয় কিছু বাজারে ওই বছর ‘প্লাস্টিক চাল’ বিক্রি হচ্ছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাপকভাবে এবং দ্রুত ছড়াতে থাকা এই গুজবের পক্ষে তেমন কোনো প্রমাণ পরীক্ষায় পাওয়া যায় না। এমনকি সেই সময় একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল হয়; যাতে দেখা যায়, চাল রান্নার পর একমুঠো ভাতকে ক্রিকেট বলের মতো করা হয়েছে এবং এই বল মাটিতে ফেললেই তা লাফিয়ে ওপরে উঠছে।

এই গুজবের মাত্রা এমন আকার ধারণ করে যে, ঘানার ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অথরিটি তদন্ত শুরু করতে বাধ্য হয়। তারা প্লাস্টিক চালের সন্দেহ হলেই তার নমুনা কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করতে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানায়। তদন্ত শেষে ঘানার ফুড অ্যান্ড ড্রাগস অথরিটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, ঘানার বাজারে কোনো ধরনের প্লাস্টিকের চাল বিক্রি হয়নি।

তাহলে প্লাস্টিকের চালের এই গুজব আসলে এল কোথায় থেকে। ভোক্তাদের ঠকানোর উদ্দেশে প্লাস্টিক চাল তৈরির পর সেগুলো আসল চালের সঙ্গে মিশিয়ে বাজারে ছাড়া হচ্ছে বলে ২০১০ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব রটে। আর এই চালের উৎপাদন চীনে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা।

riceball-1

আসলে এই গুজবের নেপথ্যে ছিল চীনের ভেজাল চাল কেলেঙ্কারির এক ঘটনা। চাল কেলেঙ্কারির এ ঘটনায় চীনের কোম্পানিগুলো নীরবতা পালন করে সেই সময়। তবে তারা জানায়, উচ্যাং নামের এক শস্য দানা থেকে তৈরি ভোজ্য চাল নিয়েই প্লাস্টিক চালের গুজব উঠেছে।

পরে ২০১১ সালে খবর বেরোয়, আলু এবং আঠাল এক ধরনের রসের ব্যবহার করে চাল তৈরি করা হয়েছিল। এই গুজবে ঘি ঢালেন চীনের রেস্টুরেন্ট সংস্থার এক কর্মকর্তা। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, প্লাস্টিকের চালের তিন বাটি ভাত খাওয়া এক ব্যাগ প্লাস্টিক খাওয়ার সমান।

এক পর্যায়ে নিশ্চিত করা হয় যে, চীনে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকের চিপস চাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তবে শিপিং বক্সে ব্যবহারের জন্য প্লাস্টিকের চাল উৎপাদন করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাল আকৃতির এই প্লাস্টিক চিপসের উৎপাদন ব্যয় প্রকৃত চালের চেয়ে অনেক বেশি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে আফ্রিকায় এই প্লাস্টিক চালের গুজব পৌঁছায় ২০১৬ সালে। ওই বছর নাইজেরিয়ার কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আড়াই টন চাল জব্দ করে। কাস্টমস কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে দাবি করেন, জব্দকৃত চাল প্লাস্টিকের তৈরি। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের এই মন্তব্য থেকে পিছু হটে যখন দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

তবে চাল পরীক্ষার পর নাইজেরিয়ার জাতীয় খাদ্য ও ওষুধ সংস্থা জানায়, জব্দকৃত চালে অতিমাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি আছে।

rice

ভাতের বল

কিন্তু গুজব অব্যাহত থাকে যে, চাল হিসেবে বিক্রি হচ্ছে প্লাস্টিক। আর এই গুজবে জ্বালানি যোগায় একটি ভিডিও। এতে দেখা যায়, ভাতের বল মাটিতে ফেলার পর তা ওপরে লাফিয়ে উঠছে। কারখানায় কীভাবে তৈরি হচ্ছে এই প্লাস্টিকের চাল অনেকে সেই প্রক্রিয়া-পদ্ধতিও দেখায় ভিডিওতে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিল্প গোষ্ঠী ও দেশটির চাল সংস্থার পরিচালক আলেকজান্ডার ওয়া বলেন, ভিডিওটি সত্য হতে পারে; কিন্তু শস্যদানা প্লাস্টিক হবে, এটা সঠিক নয়। বিবিসির ট্রেন্ডিং রেডিও প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, যদি সঠিক উপায়ে চাল রান্না করা হয়, তাহলে সেটি প্লাস্টিকের আকার ধারণ; এমনকি বাউন্সও করতে পারে।

ওয়া বলেন, চালের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট হচ্ছে এটি কার্বোহাইড্রেট এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ। চাল দিয়ে আপনি ওই ধরনের কিছু তৈরি করতে পারেন। ফরাসী সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স২৪ এর সাংবাদিক অ্যালেক্সান্দ্রে ক্যাপরনের মতে, এই গুজব ছড়ানোর নেপথ্যে থাকতে পারে সাধারণ মানুষের সুরক্ষাবাদ এবং বিদেশি আমদানির ওপর অবিশ্বাস।

প্লাস্টিক চালের গুজব নিয়ে প্রচুর পরিমাণে কাজ করেছেন ফরাসী এই সাংবাদিক। তিনি বলেছেন, কিছু মানুষ ভোক্তাদের স্থানীয় চাল কিনতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাছ-বিচারহীনভাবে ভুয়া ভিডিও শেয়ার করছেন। সাংবাদিক অ্যালেক্সান্দ্রে ক্যাপরন বলেন, এ ধরনের গুজব সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় চাল আমদানি নির্ভর আইভরিকোস্ট অথবা সেনেগালের মতো দেশগুলোতে। গুজব ছড়ানোর মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, দেশগুলোর সরকারকে শেষ পর্যন্ত প্লাস্টিকের চাল নেই বলে বিবৃতিও দিতে হয়।

riceball-2

বিবিসির ফোকাস অন আফ্রিকা প্রোগ্রামের হাসান অরোনি প্লাস্টিক চালের গুজবের ব্যাপারে খোঁজ-খবর রাখছিলেন। তিনি বলেন, পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর মানুষ কেন খাদ্য রফতানিকারক চীনকে নির্বিচারে টার্গেট করছেন তা তিনি নিশ্চিত নন। তবে এ ধরনের গুজব মোকাবেলায় পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে মনে করেন তিনি।

প্লাস্টিক চাল আদৌ কি আছে?

২০১৭ সালের জুনের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের তেলেঙ্গানার স্থানীয় একটি বাজারে প্লাস্টিকের চাল বিক্রির গুজব ছড়িয়ে পড়ে। নমুনা পরীক্ষার পর তেলেঙ্গানার খাদ্য নিরাপত্তা সংস্থার কর্মকর্তা ওসমান মহিউদ্দিন বলেন, প্লাস্টিকের চালের গুজব এবারই প্রথম নয়।

২০১৬ সালে চীনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর এই গুজব তেলেঙ্গানায় আসে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ প্রমাণ দেখাতে পারেনি যে, এমন চাল আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালে ভেজাল মেশানো যেতে পারে, এর বেশি কিছু নয়।

আসল-প্লাস্টিক চাল চেনার উপায়

মহিউদ্দিন বলেন, আসল চাল এবং প্লাস্টিক চালের মধ্যে পার্থক্য বের করা খুবই সাধারণ ব্যাপার। চালগুলোকে একটি পানির পাত্রে ছেড়ে দিন। যদি ডুবে যায়, তাহলে আসল। ডুবে না গেলে ধরে নিতে হবে এই চালে অন্য কোনো উপাদান মেশানো হয়েছে।

সূত্র : বিবিসি, দ্য নিউজ মিনিট।

এসআইএস/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।