শনি-রবি-সোমের ক্রিকেট বন্দনায় সেই স্যার ডন
শনি। রবি। সোম। পরপর তিন দিন বড় তিনটা ঝাঁকুনি লাগলো ক্রিকেট গ্রহে। শনিবার ক্রিকেট বিশ্ব দেখলো আর্থার রবার্ট মরিসের জীবন অস্ত গেলো। রবিবার ক্রিকেট থেকে বিদায় নিলেন মাইকেল ক্লার্ক। আর সোমবার? ভারত মহাসাগর পাড়ে কুমার সাঙ্গাকারার ক্রিকেটীয় সূর্যাস্ত! এবং কাকতালীয়ভাবে তিনটা ঘটনার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে উঠে এলো এক স্বর্গবাসীর নাম। স্যার ডন ব্যাডম্যান!
আর্থার মরিস ছিলেন ব্র্যাডম্যানের খুব প্রিয় ওপেনার। তাঁর এক সময়ের ডেপুটিও। সিডনির শহরতলির বাড়ি থেকে স্যার ডনের সঙ্গে দেখা করতে আর্থার মরিস যখন পাড়ি জমালেন, তখন তাঁর নামের পাশে ৯৩ বছর। আর্থার চলে যাওয়ায় স্যার ডনের আটচল্লিশের দলের একমাত্র জীবিত সদস্য বলতে ক্রিকেট গ্রহে রইলেন ৮৬ বছর বয়সী নিল হার্ভি। সেই প্রাক ফ্রন্টফুট জমানা, যখন উইকেট থাকতো আনকাভারড সেই সময় ব্র্যাডম্যানের দলের এই ওপেনার ৪৬ টেস্টে করেছিলেন ৩৫৩৩ রান। গড় ৫৬ দশমিক ৪৮। মরিস কতো বড় ব্যাটসম্যান ছিলেন তা নিয়ে অনেক মতবাদ আছে। নেভিল কার্ডাসের মতো বড় ক্রিকেট লিখিয়ে তাঁকে খুব একটা পাত্তা দিতে চাননি। কিন্তু তাতে কিছু এসে যায়নি মরিসের। কারণ, ডনের পরামর্শ, আশীর্বাদ, ভালবাসা তাঁর সঙ্গে ছিল সব সময়। বয়সে ডনের চেয়ে ষোল বছরের ছোট ছিলেন আর্থার। কিন্তু সব সময় ছিলেন ডনের স্নেহধন্য। ক্রিকেট বিধাতাও তাই স্যার ডনকে নিয়ে লেখা চিত্রনাট্যের শেষ দৃশ্যে রেখে দিয়েছিলেন আর্থার মরিসকে! ওভালে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচে স্যার ডন যখন ব্যাট করতে নামলেন তখন উইকেটের অন্যপ্রান্তে ছিলেন আর্থার মরিস। হোলিসের যে বলে ডন শুন্য রানে ফিরে যান সেই বলটাও খুব কাছ থেকে যারা দেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আর্থার মরিস। ওভালে ডনের টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে শুন্য করা নিয়ে অনেক রকম কথা আছে। তবে আর্থার মরিসের কথাটাই একটু বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ, নন স্ট্রাইকিং এন্ডে তিনিই ছিলেন। স্যার ডন ফিরেছিলেন শুন্যতে। কিন্তু আর্থার মরিস করেছিলেন ১৯৬ রান। এখানেও সেই চার রানের এক গল্প। শেষ ইনিংসে ব্র্যাডম্যান আর মাত্র চার রান করলে তাঁর টেস্ট গড় থাকতো ঠিক একশ। আর আর্থার মরিস চার রান করলে টেস্ট ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরিটা হয়ে যেতো তাঁর। কিন্তু ক্রিকেট বড় নির্মম রসিকতা করে মাঝেমধ্যে। একজন ১৯৬ রানের ইনিংস খেললেন। কিন্তু মানুষ তাঁর সেই ইনিংসের চেয়ে বেশি মনে রাখলেন স্যার ডনের শুন্য-কে। অতএব ক্রিকেটে রান অনেক কিছু আবার অনেক কিছু নয়!
আর্থার মরিস স্যার ডনের ডেপুটি ছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট গ্রহে ডনের খুব দূরবর্তী প্রতিবেশি তিনি। তবে কভু কাছের। মরিসের চেয়ে বেশি রান, ভাল গড় নিয়ে অনেকে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন। কিন্তু তাঁতে কি? হবস, হাটন, গাভাস্কার কেউ কিন্তু স্যার ডনের সেরা একাদশে ওপেনার হিসেবে ছিলেন না। ছিলেন অার্থার মরিস। শনিবার আর্থার মরিসের ওপারে পাড়ি দেয়ার মধ্যে দিয়ে ক্রিকেটের একটা ধারাও বিলুপ্ত হয়ে গেলো! অপেশাদার ভদ্রলোক ক্রিকেটের শেষটা ধরে রেখেছিলেন আর্থার। ওপারে গিয়ে হয়তো প্রিয় অধিনায়ককে বলতে পারবেন; ‘স্কিপার, চলে এলাম! ওভালে ক্লার্ককেও দেখে এলাম। গোটা পনের রান করলো বটে।’
হ্যাঁ, রোববার ওভালেই শেষ হলো ব্র্যাডম্যানের নাতির প্রজন্ম মাইকেল ক্লার্কের টেস্ট ক্যারিয়ারও। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক ট্রফি হাতে নিয়ে ২৯ মার্চ ওয়ানডে থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। টেস্ট থেকে বিদায় নিলেন সেই ওভালে যেখানে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান খেলেছিলেন তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। ইনিংস ব্যবধানে টিমমেটরা তাঁকে জয় উপহার দিলেন। কিন্তু অ্যাশেজ খুঁইয়েছেন। তাই জয়ের আনন্দের মধ্যেও হারের বিষাদ ছুঁয়ে গেছে ক্লার্ককে। ওরকম একটা মিশ্র অনুভুতি নিয়ে ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর সময় দারুণ একটা কথা বলেছেন মাইকেল ক্লার্ক। ‘এই গ্রহের সব জায়গায় ক্রিকেট হোক। সব মানুষ যাতে ক্রিকেটের মতো মহান একটা খেলা দেখতে পান।’ আসলে পরিসংখ্যান দিয়ে ক্লার্কদের মতো ক্রিকেটারকে ব্র্যাকেটবন্দী করা যায় না। সেটা করার চেষ্টা না করাই ভাল।
শনিবার আর্থার মরিসের চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে অপেশাদার ভদ্রলোক ক্রিকেটারের শেষ ধারাটা যখন বিলুপ্ত হলো, তারপর সোমবার ক্রিকেট বিশ্ব দেখলো একজন পেশাদার ভদ্রলোক ক্রিকেটার বাইশগজকে বিদায় জানালেন চোখের জলে! কুমার সাঙ্গাকারা অনেক বড় ক্রিকেটার। অসম্ভব ভদ্রলোক। দারুণ একজন মানুষ। তর্কযোগ্যভাবে বলা যায় শ্রীলংকার সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। অরবিন্দ ডি-সিলভার কথা মাথায় রেখেও বলতে হচ্ছে সাঙ্গাকারাই সেরা। কারণ, পরিসংখ্যান তাঁর হয়েই কথা বলছে। কলম্বোর পি সারা ওভালে বিষাদাচ্ছন্ন যে রাজকীয় বিদায় তিনি নিলেন তা ছাপিয়ে গেলো সব শ্রীলংকানকে। এই উপমহাদেশের একমাত্র মাঠ পি সারা ওভাল যেখানে খেলেছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান সেই সেখানেই ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটা খেললেন কুমার সাঙ্গাকারা। শেষ ইনিংসে করলেন ১৮ রান! ঠিক সাঙ্গার সঙ্গে যায় না! কিন্তু ব্র্যাডম্যানওতো ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে করেছিলেন ০! আসলে ০, ১৫, ১৮ এতে কিছু এসে যায় না। মানুষ ঐ সংখ্যাগুলোকে নয়, নামগুলোকেই মনে রাখবে।
তবে হ্যাঁ, শনি-রবি-সোম যা ঘটলো ক্রিকেট বিশ্বে তাতে ‘কমন নাম’ হয়ে বার বার উঠে এলো স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। শনি-তে চলে গেলেন ডনের প্রিয় আর্থার মরিস।ওভালে ডনের শেষ ইনিংসের পার্টনার। রোববার ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন ব্যাগি গ্রিন পরা ব্র্যাডম্যানের নাতির প্রজন্ম মাইকেল ক্লার্ক। বিদায় মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সেই ওভাল। আর সোমবার ব্র্যাডম্যানের স্মৃতিধন্য উপমহাদেশের একমাত্র মাঠ পিসারা ওভালে থামলেন কুমার সাঙ্গাকারা। টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরিতে ডনের ঘাড়ের কাছে গরম নিঃশ্বাস ফেলছিলেন যিনি। সব মিলিয়ে শনি-রবি-সোমের ক্রিকেট বন্দনায় বহুবার উচ্চারিত হলো ব্র্যাডম্যানের নামটা!
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনজুরি টাইম’ ‘এক্সট্রা টাইম’ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কাজ করেছেন দেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে, টেলিভিশন এবং দেশি-বিদেশি রেডিওতে।
এইচঅার/পিআর