কবিতার সঙ্গে আজন্মের সখ্য
কবিতার সঙ্গে আজন্মের সখ্য
সাবেরা তাবাসসুম
যারা কবিতা লেখেন বা লেখালেখির চর্চার ভেতর থাকেন আলাদা করে তাদের কোনো কবিতা-ভাবনা থাকে কি? থাকতে পারে আবার না-ও থাকতে পারে। তবে কারণ বলি, প্রেরণা বলি- এগুলো থাকে নিশ্চয়ই। দুনিয়ায় এত রকম কিছু করার থাকতে কেনই-বা এই অসুখে ভুগবে বেচারা সেটা বোধগম্য নয় অনেকের কাছে। যিনি লেখেন হয়তো তার কাছেও। আমি এই অসুখে ভোগা কতিপয়দের একজন বলে মনে হচ্ছে। অসুখটা কবিতার। বিলবোর্ডে ছবি টাঙানো থাক চাই না-থাক, আসর শেষে অস্বস্তি নিয়ে কেউ হাতে খাম গুঁজে দিক বা না-দিক কিংবা কাক-ভোরে উঠে অফিস যাওয়ার তাড়া থাকা মানুষটি হই বা না-হই, কোনো খেদ নেই। জীবন সুন্দর, জীবন কুৎসিত, জীবন তিক্ততায় ভরা নোনা-মৃত্যুর প্রস্তুতকারক- জীবন যা ইচ্ছে তা-ই। আর সে যে আমাদের কত কী শেখায়, কত কী করিয়ে নেয় আমাদের দিয়ে, কে জেনেছে তা এই জীবনে! আমি কবিতা লিখি বা লেখার চেষ্টা করি আমার প্রিয়তম পিতার জন্যে। উনিই আমার এই অসুখে ভোগার কারণ, অনুপ্রেরণা, যা যা বলা যায় তার সবটাই। ছোটবেলা থেকে উনি প্রতিনিয়ত চেয়েছেন যেন আমি কবি হই। কেন উনিই-বা এই বিচিত্র অসুখে ভুগেছেন কে জানে। হয়তো অসুখটা তাঁর কিংবা আর কোনো প্রত্মনারীর পরম্পরায় যা আমার শিরায় ধাবমান। শুনেছি মানুষ অভিজ্ঞতার সমষ্টি। এই আমি মানুষটা, হিসাব মতে, তাদের সমষ্টির অংশ, নই?
সাবেরা তাবাসসুম-এর দুটি কবিতা
এক.
এবং বুজুর্গ বৃক্ষের কাছে শেখা সহিষ্ণুতা
১.
উড়ে যাওয়া পাখির কাছে মানুষ খুব কমই এসেছে
বসেছে বা বলেছে দু দণ্ড শুকসারী-কথা
বরং আপাত স্থির দৃশ্যে তারা বৃক্ষের কাছে অবনত
কখনও বা নিখুঁত কুঠার
অথচ তোমার সহিষ্ণুতা পাখিকেই মানাবে ভেবে
এতটা পথ দৌড়ে যাচ্ছো!
২.
কী আশ্চর্য তুমি হাতের স্বপ্ন দ্যাখো
অথচ তীব্র ঘুম পাচ্ছে বলছো!
আর আলাদা করে অন্যজন রেখার নিবিড় স্টাডি করে
ভয়ানক সুস্বপ্ন তোমাকে ভয় পাওয়া পশু বা পাখির থেকে
খুব বেশি স্বস্তি দেয় না
পেখম তোলো
পুরুষ ময়ূর নয় জেনে তাকে সাজাও
এই ভেবে না যে সে আসলে কাক
এই অপ্রিয় (অধিকাংশের) পাখিটিকে
তুমি না পোষো, অন্তত একদিন
কিছু খেতে দিও
৩.
‘দীর্ঘতার পরিমিতি বড় সহজ তো নয়’
মন
চুপচাপ হাত গুটিয়ে ব’সো
মেঘ করেছে
বেলা বাড়লো বোধহয়
এবং খননকাজ এখন ব্যয়বহুল
অন্ধকারে তুমি এমনি আলো কখনোই জ্বালবে না
পারো যদি মৌন থেকো
নয়তো ঝরে প’ড়ো
পাতাদের সাথে
দুই.
নির্দেশকের ছবির গল্প
‘মিঃ বোরিং’-এর ক্লাস ভাল লাগতে শুরু করেছে। আমি একটু একটু করে খুলছি অপরিচিত সব জানালা। তিনি বলেন, দেখান, থামেন কিছুটা আবার বলেন। ভাঙা হাতের আঙুলে আলগোছে ধরে রাখেন অমোচনীয় কালির কলম। নির্দেশক ক’জনই বা হবে তবু সবাই মনোযোগী ছাত্র হতে চায়। আমি এসবের কিছুই ভাবি না কেবল জানতে চাই তিনি ‘পর্দা’ উচ্চারণ করলে আমি কেন ‘পদ্মা’ শুনতে পাই? জিভের আড়ষ্টতা তাকে জড়িয়ে ফেলে সাথে সাথে আমাকেও। ‘মিঃ বোরিং’ শিল্প সমালোচনা করেন, আমি শিল্পের কিছুই বুঝি না। তাও ভাল লাগে ইমেজ, স্থাপত্য, নাট্যকলা। পৃথিবীর নামি-দামি তারকারা আসে না তার কথায়। তিনি যখন বলেন বাস্তববাদী তখন পুরোটাই বাস্তব হবে ভেবে নিই। ভাবতে থাকি স্কার্ফ উড়ে যাওয়া তারকা বা অভিনেতা নয়, চাই তেতে ওঠা আচরণকারী। যখন বলেন পর্দায় মায়াবী ভ্রম তৈরি করতে হবে তখন আমার হাসি পায়। এই যে তাকে একটু একটু করে ভাল লাগছে, দেখলেই চুলগুলো ছেঁটে আচড়ে দিতে ইচ্ছে করে আর ইদানিং গাঢ় করে কাজল টেনে ক্লাসে যাচ্ছি এর অর্থ কী, আমার টকটকে লাল টিপটা আরও বেশি করে তার নজরে পড়ুক? তত্ত্বের খাতা খুলে উড়ে যাক মায়া আর আমার প্রশ্নকে তার বুঝতে না পারার কাছে ভ্রমেরা আসুক? তবু যেন বুঝতে পারছি এই ডুবে ডুবে জল না খাওয়ার মানে, মানে কিছুই না, যেন আমরা কেউই কোনো ব্যক্তিগত ছবি তৈরি করছি না, যেন স্বল্পদৈর্ঘ্যবাঁক পেরিয়ে নদীপথে ভাসলো ছোট্ট একটা ছইওয়ালা নৌকা।
কবি পরিচিতি :
সাবেরা তাবাসসুমের জন্ম পৌষের শীতে; ১৩ জানুয়ারি ১৯৭৮। মা: খালেদা সাঈদ ভুইয়া, বাবা: মোঃ সাইদুল হক ভুইয়া। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা: নৃবিজ্ঞানে; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই ভাইয়ের মাঝে একটি মাত্র বোন হওয়াতে আদরে বখে গেছেন পুরোপুরি। জীবনের অনেকটা পথই কেটেছে মাখনের মসৃণতায়। মা আর দাদুর চলে যাওয়ার ভেতর দিয়ে দেখেছেন জীবনের অপর পাশটাও। যৌথ জীবন যাপন করছেন মজিব-উল হাসান নয়নের সাথে।
জীবন এবং কবিতা যাপনে পাশে পেয়েছেন পরম-বন্ধু বাবা ও বন্ধুদের।
বাবার চাকরিসূত্রে ঘুরে বেরিয়েছেন বাংলাদেশের নানান জায়গা।
স্পর্শকাতর বলে পেশাজীবনে দুর্বল ও বেমানান। উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন প্রায় ১১ বছর। অতিসংবেদনশীলতায় নিজে ভোগেন; ভোগান স্বজন এবং বন্ধুদেরও। এখন একমাত্র ছেলে সুফি দানিয়ুবকে নিয়ে কাটে বেশির ভাগ সময়।
কবিতার সাথে আজন্ম সখ্য; কবিতার ‘প্লাটফরম’ নামে কবিতার আড্ডার
আয়োজনে আছেন দুই কবিতা-বন্ধু সাকিরা পারভীন ও শাহনাজ নাসরীনের সাথে।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১১।শিরোনামহীন ব্যাকুলতা (১৯৯৪),আমি যখন, জানবো আমার মৃত্যু হয়েছে (১৯৯৮), রায়তি ভূমি (২০০০), আরশি (২০০১), জোহান্সবার্গে সোনা নিয়ে যেও না (২০০৩), এবং বুজুর্গ বৃক্ষের কাছে শেখা, সহিষ্ণুতা (২০০৪), মা এখন বাক্সবন্দি (২০০৮), পিতামহী ও স্বাধীন রাষ্ট্র (২০১০), নিরাকার তোমার আয়নায় (২০১১), কোলাহলে নেই সেই পাখি (২০১৪) এবং নুন সত্য চিনি সত্য (২০১৫)।
এইচআর/আরআইপি