‘আমি নারী না কি পুরুষ, তা আমিই নির্ধারণ করবো’
নিজেদের কোন লিঙ্গের বলে পরিচয় দেবেন সেটা নিজেরাই নির্ধারণ করতে চান ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীরা। ভারতের ট্র্যান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সদ্য পাস হওয়া একটি বিল নিয়ে ওই সম্প্রদায়ের মধ্যেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
গত সপ্তাহে পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ লোকসভায় বিলটি পাস হয়। এরপর থেকেই পুরো ভারতজুড়ে রূপান্তরকামীরা বলতে শুরু করেছেন যে ওই বিলে আসলে তাদের অধিকার রক্ষার বদলে অধিকার খর্ব করার ব্যবস্থা করেছে সরকার।
তারা বলছেন, নিজেদের লিঙ্গ কী, সেটা তারা নিজেরাই ঘোষণা করার অধিকারী, কিন্তু আইনে সেই অধিকার খর্ব করা হচ্ছে। এ ছাড়াও হিজড়াদের ভিক্ষা করে জীবনধারণকেও বেআইনি বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিলে রূপান্তরকামীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরি- এসব বিষয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট রূপান্তরকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে রায় দিয়েছিল, নতুন বিলটি তার অনেকটাই বিপরীত বলে মনে করছেন রূপান্তরকামীরা। সেই দিক থেকে আদালতের অবমাননাই করা হয়েছে এই বিলে।
রূপান্তরী নারী ও অ্যাক্টিভিস্ট রঞ্জিতা সিনহা বলেন, ‘আমাদের পরিচয় কীভাবে নির্ধারিত হবে, সেটা এই বিলে যেভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তা নিয়েই মূল বিরোধ। যেখানে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল, যে কেউ নিজেকে নারী অথবা পুরুষ হিসাবে পরিচয় দেয়ার অধিকারী, এই বিলে তো উল্টো কথা বলা হলো। একটা স্ক্রিনিং কমিটির কাছে হাজির হয়ে লিঙ্গ নির্ধারণ করতে হবে। এর থেকে পিছিয়ে পড়া মানসিকতার দৃষ্টান্ত আর হয় না। এই সরকার সেটাই করতে চলেছে এই বিলের মাধ্যমে।’
এই বিলে লেখা হয়েছে, যেসব রূপান্তরকামী অপারেশন করিয়ে একটি নারী অথবা পুরুষে পরিণত হয়েছেন, তারা ছাড়া অন্য যে কেউই ট্র্যান্সজেন্ডার পরিচয় পেতে গেলে জেলা স্তরের স্ক্রিনিং কমিটির সামনে হাজির হতে হবে।
ওই কমিটিতে ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও একজন ট্র্যান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি থাকবেন।
তামিলনাডুর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে রূপান্তরীদের সংগঠনগুলি বলছে, ওই স্ক্রিনিং কমিটির সদস্যরা রীতিমতো গায়ে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন যে একজন সত্যিই রূপান্তরী কি না!
রূপান্তরকামীদের সংগঠন আনন্দমের সচিব সিন্টু বাগুই, যিনি পুরুষ থেকে নারী হয়ে উঠেছেন, তিনি বলছিলেন, ‘সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির যে কথা বলা হচ্ছে, সেটা তো তৃণমূল স্তরে থাকা আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষরা করতেই পারবেন না, এত খরচ সাপেক্ষ। তবে তার থেকেও বড় কথা আমি অপারেশন করাবো কি না? অথবা আমি নারী না পুরুষ, সেটা তো আমিই ঠিক করব। অন্য কেউ কীভাবে সেটা নির্ধারণ করবে!’
এই বিলের আরেকটি যে বিরোধীতার জায়গা তৈরি হয়েছে, সেখানে রূপান্তরকামীদেরই সম্প্রদায়ভুক্ত হিজড়াদের ভিক্ষা করাকে বেআইনি ঘোষণা করা। চিরাচরিতভাবে রাস্তায় বা বাড়িতে ঘুরেই ভিক্ষা করে থাকেন হিজড়ারা। কিন্তু সদ্য পাস হওয়া বিলটিতে হিজাড়ারা ভিক্ষা করতে গিয়ে ধরা পরলে ছ মাস থেকে দুবছরের জন্য জেলও হতে পারে।
সিন্টু বাগুই বলেন, ভিক্ষা করাকে বেআইনি যখন বলা হলো- অন্যদিকে তাদের উন্নতির জন্য কোনো ব্যবস্থাই রাখা হল না বিলটিতে। বিলে না আছে চাকরির বিষয়, না রয়েছে স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় কোনো কথা, বা পড়াশোনার বিষয়। একজন পিছিয়ে পড়া ট্র্যান্স সম্প্রদায়ের সদস্য যদি স্কুল বা কলেজছুট হয়ে যায়, তার ভবিষ্যৎ কী হবে, এসব কোনো কিছুই বলা হয়নি বিলে।
সদ্য পাস হওয়া বিলটির বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। কোথাও রূপান্তরী নারী-পুরুষরা অবস্থান কর্মসূচি বসেছেন, কোথাও সাধারণ মানুষদের মধ্যে নিজেদের সম্প্রদায়ের ব্যাপারে সচেনতা গড়তে চলছে প্রচার, কোথাও আবার সংবাদ সম্মেলন করা হচ্ছে।
গত কয়েকদিনে কলকাতাতেও এরকম কয়েকটি সংবাদ সম্মেলন করেছে রূপান্তরকামীদের নানা সংগঠন। রোববার তারা শহরে একটি মিছিলও করবে।
সূত্র : বিবিসি
এমবিআর/এমএস