গোপন আশ্রয়কেন্দ্রে লড়াই করে বেঁচে আছেন ইরাকের নারীরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:০২ এএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮

ইরাকে নারীদের জীবন এমনিতেই বেশ কঠিন। জাতিসংঘ বলছে, দেশের মোট নারীদের প্রায় অর্ধেক কোন না কোনভাবে পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক অভিযানের পর ইরাকে নারী পাচারও বেড়েছে। কিন্তু সরকার এসব নারীকে রক্ষা করতে পারছে না।

ইয়ানার মোহাম্মদ হলেন এমনি এক নারী যিনি গত ১৫ বছর ধরে সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে আসছেন।

ইয়ানার বলেন, আমরা যেসব নারীকে আশ্রয় দেই তাদের মধ্যে অনেককেই পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। নারী পাচারকারী কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। অনেকেই পরিবারের ভেতরে সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছেন। আমরা এদের রক্ষা করার চেষ্টা করছি। আর সেকারণেই কি এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে গোপন রাখতে হচ্ছে?

তিনি বলেন, আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে অবশ্যই গোপন রাখতে হবে। তার কারণ, যারা নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়, তারা প্রায়ই তাদের অনুসরণ করার চেষ্টা চালায়। তারা এদের অপহরণ করতে চায়, হত্যা করতে চায়। আর অন্যদিকে সরকারের হাত থেকেও এদের রক্ষা করতে হবে। সরকার বলে আমাদের এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো অবৈধ।

বাগদাদে এই ধরনের গোপন নারী আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে চারটি। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করেন যেসব নারী, তারা নিজেরাও একসময় সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সাত বছর আগে বাসমাকে তার পরিবারের এক সদস্য খুন করতে চেয়েছিল। তার বাবা এবং তার গোত্রের সদস্যরা এখনও তার খোঁজ করছে। কিন্তু তারপরও তিনি এই গোপন আশ্রয়কেন্দ্রটি পরিচালনা করছেন।

কিন্তু এখানে তার নিজের কিংবা তার সাথে থাকছেন যেসব নারী তাদের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি চিন্তিত কিনা সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই আমি চিন্তিত। আমাদের সবার অবস্থা একই রকম। আর সে কারণেই একে অন্যকে সাহায্য করা বেশি দরকার। কারণ আমি যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, এখন তারাও সেই একই পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।

আমার পরিবার যদি আমাকে ধরতে পারে, তাহলে তারা আমাকে মেরে ফেলবে। এদেরও একই অবস্থা। পুলিশের কাছ থেকেও আমি ভয়ের মধ্যে আছি। যদি পুলিশ এদের ধরতে পারে, তাহলে তারা আইডি কার্ড চাইবে। কিন্তু এই নারীরা অনেকেই সেই কার্ড ছাড়াই বাড়ি থেকে পালিয়েছে।

এসব আশ্রয় কেন্দ্রে মোট ৫২ জন বাসিন্দা রয়েছেন। কিন্তু ইরাকে যেসব নারী মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, এই সংখ্যা তার তুলনায় খুবই নগণ্য। পঁচিশ বছর-বয়সী সালওয়া জানান, তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছেন ছয় বছর আগে। নিরাপত্তার স্বার্থে সালওয়ার নামধাম গোপন রাখতে হচ্ছে। চার বছর বয়সে সালওয়ার মা মারা যায়। তারপর থেকে তিনি দু’টি বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন।

তিনি জানাছেন, তারা তাকে নিয়মিতভাবে মারধর করতো। একবার তাদের বাসায় এক মেহমান এসেছিল। সে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল।

তিনি বলেন, আমি লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করতাম। ওই পরিবারটি যখন বিদেশে চলে গেল, তখন আমি আরেকটি পরিবারে কাজ শুরু করি। কিন্তু আমার জীবনে কোন পরিবর্তন এলো না। ওই পরিবারের কর্তাও আমাকে ধর্ষণ করেছিল।
কিন্তু সালওয়া কেন সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন না? তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে কি আমি পালানোর কথা মোটেই ভাবছিলাম না। আমি চেয়েছিলাম আত্মহত্যা করতে। জীবনটা এমন এক পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল যে পশুর জীবন আর সহ্য হচ্ছিল না।

গত পাঁচ বছর ধরে অর্গানাইজেশন ফর দ্য উইমেন্স ফ্রিডম ইন ইরাক নামের এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় এক হাজার নারীকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে সাহায্য করেছে। সালওয়া এখন বিবাহিত। তার দুটি বাচ্চা রয়েছে। যে শৈশবের স্বাদ তিনি নিজে পাননি, তার আশা তার সন্তানরা সেই জীবন, সেই শিক্ষার সুযোগ পাবে।

তার জীবন এখন কতখানি বদলে গেছে জানতে চাইলে সালওয়ার মুখ হাসিতে ভরে যায়। তিনি বলেন, সেই পুরনো সালওয়া এখন আর নেই। আমি এখন নতুন সালওয়া। আমি এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমি এখন নিজেকে রক্ষা করতে পারি। এখন আমাকে আর চুপ করানো যাবে না।

বাসমা, সালওয়া কিংবা অন্যান্য যারা ইরাকের এসব আশ্রয়কেন্দ্রে দিন যাপন করছেন, তারা জানেন কতটা ঝুঁকির মধ্যে তারা রয়েছেন। বেঁচে থাকার জন্য তাদের এই লড়াই আসলে প্রতিদিনকার লড়াই।

টিটিএন/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।