ভারতে ইউটিউবে হিন্দুত্ববাদের জোরালো প্রচার
জনসভা কিংবা বাড়ির দরজায় ঘুরে ঘুরে প্রচার এখন সাবেকি ধারণা। এখন অনলাইনে সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারের শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। প্রচারের ক্ষেত্র বিস্তৃত করার জন্য শিল্পীরা তাদের অ্যালবাম প্রকাশ করছেন ইউটিউবে। এই ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করে ভারতে গানের মাধ্যমে চলছে হিন্দুত্ববাদের জোরালো প্রচার।
ইতোমধ্যে ইউটিউবে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন লক্ষ্মী দুবে, সন্দীপ চতুর্বেদি, সঞ্জয় ফৈজাবাদি, নরোত্তম রঙ্গের মতো শিল্পীরা। তাদের গান মূলত প্রচারমূলক। প্রত্যেকেই হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদের পক্ষে গান বেঁধেছেন। এই গানে কখনও ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করার দাবি উঠছে, কখনও বলা হচ্ছে- ইতিহাস থেকে মোঘল সম্রাট বাবরের নাম মুছে ফেলতে হবে। কখনও টার্গেট করা হচ্ছে কোনো বিশেষ সম্প্রদায় বা রাষ্ট্রকে।
সঙ্গীতের উৎকর্ষের বিচারে এগুলো কতটা মানোত্তীর্ণ, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ রয়েছে। তবে তার থেকেও বড় প্রশ্ন উঠছে গানের বক্তব্য ঘিরে। এই গানগুলোতে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সামনেই ভারতের লোকসভা নির্বাচন, তার আগে এই প্রচারের পেছনে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘অতীতে আমরা এক ধরনের তাত্ত্বিক হিন্দুত্ব দেখেছি। এখন দেখছি কর্পোরেট হিন্দুত্ব। এখানে রাজনীতিও পণ্য হয়ে উঠেছে। তারই অংশ হিসেবে সোশাল মিডিয়ায় এমন প্রচার চালানো হচ্ছে।’
যদিও শিল্পীদের বক্তব্য, তারা নিজেদের ধর্মের প্রচার করছেন। লক্ষ্মী দুবে বলেন, ‘আমি আমার ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করছি। এতে অন্যায় কী আছে? রামের গান গাইতে আপত্তি থাকার কথা নয়। আমি চাই হিন্দুদের মধ্যে একতা গড়ে উঠুক।’
কেন ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে এই গান শোনানোর কথা ভাবলেন? এর উত্তরে লক্ষ্মী বলেন, ‘অনেকগুলি বিষয় আমি দেখেছি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সময়। মসজিদ, মাদ্রাসায় অস্ত্র মজুত রাখা হচ্ছে। হিন্দু মেয়েদের ক্ষতি করা হচ্ছে। কারো বন্দেমাতরম বলতে আপত্তি। তাই মনে হয়েছে, দেশভক্তির প্রচার করা দরকার।’
এই অভিযোগ কতটা সত্যি? পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের প্রাক্তণ শীর্ষ কর্মকর্তা ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে আমি এ ধরনের কোনো অভিযোগের কথা শুনিনি। আমার সহকর্মীরাও শুনেছেন বলে জানি না। অন্য রাজ্যের কথা বলতে পারব না। তবে এটাও ঠিক, আমি জানি না বলে অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যে, সেটা বলতে পারব না।’
মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন চলাকালীন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রচারে লক্ষ্মীকে দেখা গেলেও তার দাবি, কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তিনি গান শোনাচ্ছেন না। ৩০ বছর বয়সী এই নারীর বক্তব্য, ‘বিজেপি হিন্দুদের হিতৈষী। তাই ওদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি। যদি ওরা কখনও হিন্দুদের বিরুদ্ধে কাজ করে, তখন ওদের বিপক্ষেই থাকব। রাজনীতি নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’
গান নিয়ে যে বিতর্কই থাক, ইন্টারনেটে তা বিপুল জনপ্রিয় হয়েছে। লক্ষ্মীর কোনো কোনো গান ইতোমধ্যে ২৫ লক্ষের বেশি মানুষ অনলাইনে শুনেছেন। বজরং দলের কর্মী অযোধ্যার সন্দীপ চতুর্বেদির কট্টর জাতীয়তাবাদী গানের দর্শক কয়েক লক্ষ। সামরিক পোশাক পরে দর্শকদের সামনে হাজির হওয়া দিল্লির সঞ্জয় ফৈজাবাদি তার গানে প্রতিবেশী পাকিস্তান, চীন কিংবা জঙ্গি হাফিজ সৈয়দকে আক্রমণ করছেন। প্রচুর মানুষ এই ভিডিও দেখছে।
সঙ্গীত হিসেবে উন্নত না হলেও কেন জনপ্রিয় এসব গান? উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘সর্বভারতীয় স্তরে কর্পোরেট হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক শূন্যতা রয়েছে। সেই শূন্যতা কাজে লাগাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। তরুণ সমাজ এখন কাজের অভাবে হতাশাগ্রস্ত। কোনো বিকল্প না থাকায় তাদের এই প্রচার ছুঁয়ে যাচ্ছে।’
অন্যদিকে এই প্রচারের বিপরীতে উদারপন্থিরা নিষ্ক্রিয়, নিষ্প্রভ। অনেকেই মনে করছেন, তথাকথিত উদারপন্থিদের নিষ্ক্রিয়তার ফলে কট্টর জাতীয়তাবাদী প্রচার সফল হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গেও কি এর প্রভাব পড়বে? কাজী নজরুল ইসলাম, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীরা জনচেতনার গানে এ রাজ্যের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। সেই ধারায় পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পী শুভেন্দু মাইতি গেয়েছিলেন ‘মৈনুদ্দিন কেমন আছো?’
তিনি বলেন, ‘বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, দিশাহীন। তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। আমি যদি আরেকটা মৈনুদ্দিন লিখে ইউটিউবে দিই, সে গান কতজন শুনবে? বামপন্থিরাই তো গান শোনে না। প্রতিবাদ করতে হবে মাঠে নেমে, একজোট হয়ে।’
তবে গানের পাল্টা গানকেই হাতিয়ার করার পক্ষপাতী আরেক শিল্পী পল্লব কীর্তনিয়া। তিনি বলেন, ‘আমাদের পাল্টা গান লিখতে হবে। প্রচার করতে হবে। শুধু গান কেন, নাটকও হাতিয়ার হতে পারে। উদারপন্থিরা সংখ্যালঘু, অধিকাংশ মানুষের মনে ধর্ম বাসা বেঁধে থাকে। তাই রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী পালন করছি। আমরা কিন্তু বলছি না, রামনবমীর উন্মাদনার বিরুদ্ধে আমাদের চেতনার সংস্কৃতি গড়তে হবে।’
সূত্র : ডয়েচে ভেলে
এমবিআর/এমএস