গোঁড়া হিন্দুদের ভোট টানতেই ভারতে ‘মুসলিম’ নাম বদল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:৫৩ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৮

সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে প্রতিবাদ আসলেও ক্ষমতাসীন জনতা পার্টির (বিজেপি) দৌলতে বদলাচ্ছে ভারতে একাধিক শহরের নাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরগুলো ‘মুসলিম’ নাম বদলে ‘হিন্দু’ করণের ফলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ক্ষতি হচ্ছে।

দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথের দল বিজেপি দেশজুড়ে বিভিন্ন শহরের নাম বদল করছে। গত সপ্তাহে এলাহাবাদের নাম বদলে ‘প্রয়াগরাজ’ ও ফৈজাবাদকে বদলে ‘অযোধ্যা’ করার ঘোষণা দেন আদিত্যনাথ। এর কারণ হিসাবে তারা সামনে এনেছেন ‘ইতিহাস’কে।

বিজেপির মতে, ব্রিটিশ দখলের আগেই, এই শহরগুলির মূল হিন্দু নাম বদলে মুসলিম নাম করা হয়। ১৮৫৭ সালের পর থেকে সেই নামগুলি বদলে ইংরেজি নাম রাখে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। এই ইতিহাসের চাকা উল্টো ঘোরাতে চেয়েই নাম বদলে ব্যস্ত বর্তমান বিজেপি সরকার।

কিন্তু নাম বদলের এই হিড়িক শুধু উত্তর প্রদেশেই সীমাবদ্ধ নেই। অন্যান্য বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও সেসব রাজ্যের
বিভিন্ন রাস্তা, এয়ারপোর্ট বা শহরের নাম বদল করা শুরু করে দিয়েছেন। গুজরাটে আহমেদাবাদের নাম বদলে হয়েছে কর্ণাবতী। অন্দিযকে দক্ষিণের রাজ্য তেলেঙ্গানার বিজেপি সাংসদ রাজা সিং ইতোমধ্যে হায়দ্রাবাদের নতুন নাম হিসাবে প্রস্তাব করেছেন ‘ভাগ্যনগর”। এমনকি তাজমহলের জন্য বিশ্বখ্যাত শহর আগ্রার নাম পরিবর্তন করে ‘অগ্রভান’ বা ‘অগ্রওয়াল’ করারও কথা শোনা যাচ্ছে। মুজফফরনগরকে লক্ষ্মীনগর করার প্রস্তাবও উঠে এসেছে এর মধ্যে।

এখানে লক্ষণীয়, যে শহরগুলির নাম পরিবর্তন করার দাবি উঠছে, সেই প্রত্যেকটি নামেরই রয়েছে মুসলিম শিকড়।

ফৈজাবাদের নাম ‘অযোধ্যা’ ঘোষণা করার পর আদিত্যনাথ বলেন, ‘অযোধ্যা আমাদের কাছে সম্মান, গর্ব ও মর্যাদার প্রতীক।’

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এই নাম বদলের পেছনে রয়েছে আসন্ন ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরিকল্পনা। এই নামবদল আসলে ভারতের গোঁড়া হিন্দু ভোটকে সংগঠিত করার উপায়। শহরের নামবদল বিশ্বের অন্যান্য দেশেও সাধারণ ঘটনা হলেও, ভারতের ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে দেশের ‘হিন্দুকরণ’-এর প্রক্রিয়া।

সমাজতাত্ত্বিক সঞ্জয় শ্রীবাস্তব বলেন, ‘এই নাম বদল আসলে দেশের বহুমুখী সত্ত্বার বিরোধী। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি দেশের গোঁড়া হিন্দু ভোটারদের তোয়াজ করতেই এমন কাজ করছে। কিন্তু এসবের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে যে বার্তা পৌঁছাচ্ছে, তা সমস্যাজনক।’

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর মূল লক্ষ্য ভারতকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু-মুক্ত একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ পরিণত করা। সমালোচকেরা মনে করেন, এই ধারণা দেশের সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে বৈরি মনোভাব সৃষ্টি করে, যা নামবদলের রাজনীতির মধ্যেও সমানভাবে বিরাজমান।

নয়া দিল্লীর অর্থনীতিবিদ পরীক্ষিৎ ঘোষের মতে, এই নাম বদল আসলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা সরকারের গত চার বছরের ব্যর্থতা থেকে সাধারণ মানুষের নজর ঘোরানোর কৌশল।

শুধু যে গবেষকেরা এমন মনে করছেন, তা নয়। অনেক রাজনীতিকরাও এই পদক্ষেপের বিরোধী।

লোকতান্ত্রিক জনতা দলের নেতা, শারদ যাদবের ধারণা, বিজেপির এই কাজ ভারতের বহুত্বকে ক্ষুণ্ণ করে। যে বহুত্ব স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের অন্যতম বৈশিষ্ট হয়ে এসেছে, তার চরম বিরোধী বিজেপির এই মুসলিম নাম বদলের কার্যকলাপ, বলে জানান তিনি।

নাম বদলের কাজ ভারতে বেশ অনেক বছর ধরেই চলছে। স্বাধীনতার পর, ব্রিটিশ প্রভাব থেকে বেরোনোর জন্য অনেক শহরের নাম বদলানো হয়। ইংরেজি নামের বদলে জায়গা করে নেয় বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠী দ্বারা অনুপ্রাণিত নাম।

এ বিষয়ে শ্রীবাস্তব বলেন, ‘গত ৫০ বছরে অনেক বার নাম বদল করা হলেও এবার তা করা হচ্ছে স্রেফ ধর্মের ভিত্তিতে।’

তবে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা।

আরএসএস সদস্য, রাঘব আওয়াস্থির মতে, ‘আমাদের জাতীয়তাবাদ প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির একতা ও অখণ্ডতার পক্ষে। হিন্দু রাজা ‘ভরত’ এর আদর্শ মেনে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের উদ্দেশ্য।’

হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের কৈফিয়ত দেয়া সত্ত্বেও ভারতের একাংশে এই নাম বদলের সমালোচনা থেকে যাচ্ছে। এর কারণ হতে পারে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে বাড়তে থাকা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সহিংসতা। ২০১৪ সাল থেকে একাধারে বেড়েছে ‘গো-রক্ষা’র নামে সংখ্যালঘু মুসলমান হত্যার ঘটনা। এভাবেই অতি-ডান চরমপন্থীদের উত্থানের ফলে দেশে বাড়ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গুরুত্ব।

সূত্র : ডয়চে ভেলে

এমবিআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।