চতুর ও উচ্চাভিলাষী দুই যুবরাজের গল্প

সাইফুজ্জামান সুমন
সাইফুজ্জামান সুমন সাইফুজ্জামান সুমন , সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৪৪ পিএম, ০৪ নভেম্বর ২০১৮

সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার ঘটনা ৩৩ বছর বয়সী সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) ক্যারিয়ারে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে; তা নিয়ে যখন বিশেষজ্ঞ এবং পর্যবেক্ষকরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা তুলে ধরছেন; ঠিক সেই সময় তার চেয়ে ২৫ বছরের বড় আরেক যুবরাজ একটু দূরে থেকে সব দেখছেন এবং নিশ্চয়ই একটু অস্বস্তি বোধ করছেন।

এমবিএসের সঙ্গে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ইস্যুতে জড়িয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ (এমবিজেড)। এর মধ্যে অন্যতম দুটি হচ্ছে, ইয়েমেন যুদ্ধ এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) সদস্য রাষ্ট্র কাতারের বিরুদ্ধে আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথে অবরোধ আরোপ।

এই দুটি বিষয়ের ফল বেশি সুখকর ছিল না। ইয়েমেন যুদ্ধ বর্তমানে চতুর্থ বছরে পদার্পণ করেছে। দেশটির মানুষের জন্য ভয়াবহ এক পরিণতি ডেকে আনার পাশাপাশি অচলাবস্থা তৈরি করেছে এই যুদ্ধ। গত বছরের জুনে কাতারকে পায়ের তলায় টেনে নিয়ে আসার যে পরিকল্পনা নিয়ে দেশটির ওপর সৌদি নেতৃত্বাধীন কয়েকটি দেশ অবরোধ আরোপ করেছিল, তাও ধোপে টেকেনি।

আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের কর্মকাণ্ডকে হালকা সফল হিসেবে দেখা যেতে পারে। ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে আরব আমিরাত। যা দক্ষিণ ইয়েমেনের রাজধানী খ্যাত বাণিজ্যিক বন্দর এডেনের মূল অংশের সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। এডেন ইয়েমেনের স্বাধীন ভূখণ্ড হলেও এটি এখন আমিরাতের নিজস্ব বন্দরে পরিণত হয়েছে।

কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের বিরোধিতা করে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর চাপ প্রয়োগ করলেও তা সামলাতে সক্ষম হয় সৌদি ও আমিরাত।

গত বছরের ডিসেম্বরে সৌদি আরবের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের লক্ষ্যে নেয়া পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মেলানোর চেষ্টা চালায় আমিরাতের যুবরাজও। কিন্তু এমবিজেডের এই পদক্ষেপ বেশি মনযোগ কাড়তে পারেনি। সৌদি আরবের সঙ্গে আমিরাতের স্বাক্ষরিত ‘সমাধান কৌশল’ নামে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা চুক্তিকে যুবরাজ এমবিজেড ‘এক ঐতিহাসিক সুযোগ’ হিসেবে অভিহিত করেন।

সেই সময় আমিরাতের এই যুবরাজ বলেন, ‘আমরা আরবের দুই বৃহৎ অর্থনীতির দেশ সর্বাধুনিক সামরিক বাহিনী গঠন করছি।’ কুয়েতে অনুষ্ঠিত উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) বৈঠকে দেয়া ঘোষণার মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ। ১৯৮১ সালে গঠিত জিসিসির একমাত্র জীবিত প্রতিষ্ঠাতা কুয়েতের আমির কাতারের সঙ্গে অন্য দেশগুলোর সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালান।

পরস্পর বিপরীতমুখী ও দাম্ভিকতাপূর্ণ অবস্থানে থাকা অন্য পাঁচ সদস্যের সেই বিরোধ মেটানোর কোনো পদক্ষেপ নেননি আমিরাতের যুবরাজ এমবিজেড। সদস্য দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করার মতো ক্ষমতা আছে তার। গত বছরের জুনে সৌদি আরবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে খুব দ্রুতই ৪৪টি প্রকল্পের ঘোষণা দেন তিনি। নিজ দেশের রাজধানী আবুধাবি এড়িয়ে যৌথ সমন্বয় পরিষদ নামের এক বৈঠকও করেন সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে। বৈঠকে এমবিএস সভাপতি এবং এমবিজেড সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। আর এই বৈঠকে আমিরাতের যে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন; তারা সবাই ক্ষমতাসীন এমবিজেড পরিবারের সদস্য।

কিন্তু আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী, ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। ২০১৪ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট (এমবিজেডের বড় ভাই) হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই আমিরাতের ডি ফ্যাক্টো প্রেসিডেন্টে পরিণত হয়েছেন এমবিজেড।

বৈঠকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সামরিক সহযোগিতা, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সমন্বিত রূপকৌশল, মেডিক্যাল স্টকের জন্য যৌথ পরিকল্পনা, সাধারণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও তেল, গ্যাস এবং পেট্রোকেমিক্যাল খাতে বিনিয়োগ ও যৌথ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সময় নির্ধারণ করা হয়। ব্যবসায়িক বিশ্বে এসব কৌশলকে বিপরীতমুখী ব্যবস্থা হিসেবে মনে করা হয়।

আবু ধাবির চতুর এবং অতিমাত্রায় উচ্চাভিলাষী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি লাইন চুরি করে সৌদির সঙ্গে এই চুক্তিকে ‘শতাব্দির সেরা চুক্তি’ বলে অভিহিত করেন। যেখানে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরবের জিডিপির পরিমাণ ছিল ৬৭৮.৫ বিলিয়ন ডলার, এই সময়ে আমিরাতের জিডিপি সৌদির অর্ধেকের একটু বেশি; সৌদি আরবের বিদেশি মুদ্রা ও স্বর্ণের রিজার্ভের পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, অন্যদিকে আমিরাতের ৯০ বিলিয়ন ডলারেরও কম; সৌদি আরবের রাজস্ব ১৭১.৬ বিলিয়ন ডলার, আমিরাতের মাত্র ৮৩.৪ বিলিয়ন ডলার।

একই অর্থনৈতিক কৌশলের দিকে যৌথভাবে অগ্রসর হলেও বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময়ে সমালোচনা থেকে নিজেকে আমিরাতের যুবরাজ আড়াল করতে পারলেও রেহাই পাননি সৌদি যুবরাজ। ইয়েমেন যুদ্ধের কথা বলা যেতে পারে। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে আমিরাতের সেনাবাহিনী বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হলেও বেসামরিক মানুষ ও স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালানোর দায়ে বিশ্বজুড়ে নিন্দার মুখে পড়ে সৌদি আরব।

বিশ্বে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে থাকা ইয়েমেনের জনগোষ্ঠীর কাছে ওষুধ এবং খাদ্যসামগ্রী সরবরাহে বাধা দেয়ার দায়েও অভিযুক্ত সৌদি। হুথি বিদ্রোহীদের দমনের নামে ইয়েমেনে প্রথম হামলাও চালায় এই সৌদি। যদিও হুথিদের দমনে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি রিয়াদ।

বর্তমানে সাংবাদিক জামাল খাশোগি খুনের ঘটনা নিয়ে চলমান সঙ্কটের মাঝেও ইয়েমেনে বোমা হামলা বন্ধ করতে সৌদি আরবের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ৩১ অক্টোবর মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইয়েমেন যুদ্ধে জড়িত সব পক্ষকে পরবর্তী এক মাসের জন্য যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু এর মাত্র একমাস আগেও সৌদি আরবের প্রতি ওয়াশিংটনের পূর্ণ সমর্থন আছে বলে জানিয়েছিলেন এই পম্পেও।

সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি আরবকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ সহায়তা বন্ধ করতে প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেসের সদস্যরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট সহায়তা বন্ধের হুমকির পাশাপাশি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টাও করেছেন।

কিন্তু মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট যখন পুরো মধ্যপ্রাচ্যের কথা চিন্তা করেন, তখন মোহাম্মদ বিন জায়েদের কথা আসলেই মাথায় আনেন না। আর এই বিষয়টিই আবু ধাবির প্রিন্সকে রেখেছে সুন্দর। বিশ্ব পরিমণ্ডলে খ্যাতির প্রত্যাশী ও অহঙ্কারী হিসেবে পরিচিত সৌদি যুবরাজের সঙ্গে চলতে পেরেই তিনি খুশী।

এমবিএসের ছত্রচ্ছায়ায় থেকেই মোহাম্মদ বিন জায়েদ তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জায়েদের এই সহযোগী এখন বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছেন। হত্যার নৃশংসতা, আড়াল করার আনাড়ি অপচেষ্টায় বিশ্ব পরিমণ্ডলে অনেকেই মনে করেন, সৌদি যুবরাজের নির্দেশেই খাশোগি খুন হয়েছেন; যা যুবরাজের অবস্থানকে অত্যন্ত দুর্বল করে তুলেছে।

যুবরাজের চাচা ও সৌদি বাদশাহ সালমানের একমাত্র জীবিত ভাই আহমদ বিন আব্দুল আজিজ লন্ডন থেকে রিয়াদে ফিরেছেন। গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে যে, এমবিএসকে সরিয়ে নতুন যুবরাজ নিয়োগ দেয়া হতে পারে। যদিও এটি একটি অসম্ভব দৃশ্যকল্প। আহমদ বিন আব্দুল আজিজের বয়স ৭০ ছাড়িয়ে গেছে, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসার পর বাদশাহর এই ভাই অধিকাংশ সময় লন্ডনে কাটিয়েছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে এখন তিনি রাজপরিবারে ভূমিকা রাখা ছাড়াও যুবরাজ এমবিএসের কর্মকাণ্ডেও লাগাম টানতে পারেন।

মোহাম্মদ বিন সালমান এবারে টিকে যাবেন কি-না সেটি প্রচুর বিতর্কের বিষয়। তবে বিবিসির সাবেক সাংবাদিক, আলজাজিরার কন্ট্রিবিউটর ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক বিল ল’র মতে, ‘আমি বাজি ধরে বলছি যে, যুবরাজ টিকে যাবেন। তবে তার যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও দেশের ভেতরে ক্ষমতা ছিল তাতে মারাত্মক ভাটা পড়বে। এটি এমবিজেডের জন্যও দুশ্চিন্তার। তিনি মোহাম্মাদ বিন সালমানের পেছনে অনেক বিনিয়োগ করেছেন। আর সৌদি এই যুবরাজ ইয়েমেন এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নে সামনে থেকে খেলছেন।

এখন সামনে থেকে খেলে যাওয়া এই যুবরাজ দুর্বৃত্তপনা-মূলক কাজে জড়িয়েছেন; যা তাকে নিয়ে বৈশ্বিক ভাবনার পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে আমিরাতের যুবরাজ কীভাবে তার কার্ড খেলেন; সেটিই দেখা বেশ মজার হবে। তিনি যদি এখন এমবিএসের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা কমিয়ে আনেন, তবে এখান থেকে একটি বার্তা পাওয়া যাবে যে, সৌদি যুবরাজ সত্যিই ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন।

সূত্র : আলজাজিরা।

এসআইএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।