সৌদি কর্মকর্তার ভাষ্যে খাশোগি হত্যার ‘নতুন বর্ণনা’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৫৫ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০১৮

ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন তথ্য প্রকাশ করেছেন সৌদি অারবের জ্যেষ্ঠ এক সরকারি কর্মকর্তা।

গত ২ অক্টোবর সৌদি আরব থেকে ১৫ কর্মকর্তাকে ইস্তাম্বুলে প্রেরণ, কীভাবে সাংবাদিক খাশোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরে ভয়ভীতি প্রদর্শন, অপহরণ করা হয় এবং শেষে প্রতিরোধের মুখে টুকরো টুকরো করে কাটা হয় সেব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিস্তারিত নতুন তথ্য তুলে ধরেছেন ওই কর্মকর্তা।

তিনি বলেছেন, খাশোগিকে হত্যার পর তার পোশাক পড়েই কনস্যুলেট থেকে এক কর্মকর্তা বেরিয়ে যান। যাতে বোঝানো যায়, কাজ শেষে কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে গেছেন এই সাংবাদিক।

৫৯ বছর বয়সী খাশোগির নিখোঁজের দুই সপ্তাহ পর্যন্ত চুপ থাকলেও শনিবার সৌদি আরবের পাবলিক প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে এক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, কনস্যুলেটের ভেতরে কয়েকজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক থেকে মারামারি শুরু হয়। আর এতে প্রাণ যায় খাশোগির।

তুরস্কের সরকারি কর্মকর্তাদের ধারণা, খাশোগির মরদেহ টুকরো টুকরো করা হয়েছে। কিন্তু সৌদি আরবের ওই কর্মকর্তা বলেছেন, সাংবাদিক খাশোগিকে হত্যার পর তার মরদেহ একটি গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হয় এবং সেখান থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য স্থানীয় এক কর্মচারীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।

কিন্তু খাশোগিকে নির্যাতনের পর শিরশ্ছেদ করা হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে সেব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে সৌদি ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক তদন্তে সে ধরনের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তার দেয়া এসব তথ্য সৌদি গোয়েন্দাদের অভ্যন্তরীণ নথিতে পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সৌদি আরবের দেয়া তথ্য গত ৪৮ ঘণ্টায় বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হয়েছে। কনস্যুলেটের ভেতরে খাশোগি নিখোঁজ হয় বলে যে অভিযোগ উঠেছে সেটি মিথ্যা দাবি করে সৌদি বলছে, প্রবেশের কিছুক্ষণ পরই বেরিয়ে যান তিনি। কয়েকদিন আগে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, কনস্যুলেটেই খুন হয়েছেন খাশোগি। সৌদি আরব সেসময় জানায়, এটি ভিত্তিহীন।

খাশোগি হত্যায় সরকারের দেয়া তথ্য কেন বারবার পরিবর্তিত হচ্ছে; এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওই সময় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে পাওয়া তথ্য ছিল মিথ্যা। যে কারণে তথ্য পরিবর্তিত হয়েছে।

প্রাথমিক এই তথ্যের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু হয় এবং আর কোনো মন্তব্য করা থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়। সৌদি ওই কর্মকর্তা বলেন, এই তদন্ত এখনো চলমান।

তুরস্কের সূত্রগুলো বলছে, কনস্যুলেটের ভেতরে খাশোগিকে খুনের অডিও রেকর্ড হাতে পেয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে এই রেকর্ড এখনো প্রকাশ করা হয়নি। গত মঙ্গলবার সৌদি আরবের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ইস্তাম্বুলে পৌঁছে অভ্যন্তরীণ তদন্তের নির্দেশ দেয়।

শনিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, খাশোগি হত্যার বিষয়টি সৌদি আরব যেভাবে সামাল দিচ্ছে তাতে সন্তুষ্ট নন তিনি এবং এখনো অনেক প্রশ্নের জবাব মেলেনি বলে জানান।

সৌদির ওই কর্মকর্তা বলেছেন, এক বছর আগে ওয়াশিংটনে পাড়ে জমানো সৌদি রাজপরিবারের সাবেক এই উপদেষ্টাকে রিয়াদে ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল সরকার। নাগরিকরা যাতে শত্রুদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সৌদিবিরোধী কোনো কার্যকলাপে জড়িয়ে না পড়েন সে লক্ষ্যে তাকে সৌদিতে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়।

তার ভাষ্য, গোয়েন্দা এবং নিরাপত্তাবিভাগের ১৫ সদস্যের একটি দলকে ইস্তাম্বুলে পাঠিয়ে দেন সৌদির জেনারেল ইন্টেলিজেন্স প্রেসিডেন্সির উপ-প্রধান আহমেদ আসিরি। উদ্দেশ্য, কনস্যুলেটে খাশোগির সঙ্গে সাক্ষাত করে তাকে দেশে ফিরে আনার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করা।

তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাজপরিবার বিরোধী খাশোগিকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে এই দলের প্রতি স্থায়ী আদেশ জারি ছিল। এ আদেশের ফলে তারা কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়া যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

১৫ সদস্যের ওই দল গঠন করেন আসিরি এবং আল কাহতানির সঙ্গে কাজ করেছিলেন এমন এক কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনি। লন্ডন দূতাবাসে কর্মরত থাকাকালীন থেকেই জামাল খাশোগিকে চিনতেন এই কর্মচারী।

পরিকল্পনা হয়, ওই দল ইস্তাম্বুলের বাইরে একটি বাড়িতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খাশোগিকে নিরাপদে আটকে রাখার। তবে শেষ পর্যন্ত যদি ফিরতে না চান তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। সৌদির ওই কর্মকর্তা বলেন, শুরুতেই সবকিছু ভুল পথে পরিচালিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে এই কর্মকর্তারা আদেশ লঙ্ঘন করে দ্রুত সহিংস হয়ে উঠেন।

সৌদি সরকার বলছে, খাশোগিকে কনসাল জেনারেলের কার্যালয়ে নেয়া হয়; যেখানে মাহের মুতরেব নামের এক কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি সৌদি আরবে ফেরা না ফেরা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। খাশোগি ওই কর্মকর্তার দেশে ফেরার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলেন, বাইরে তার জন্য একজন নারী অপেক্ষা করছেন। একইসঙ্গে তিনি মুতরেবকে বলেন, যদি তিনি এক ঘণ্টার মধ্যে কনস্যুলেট ভবন থেকে বের না হন, তাহলে তুরস্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বাইরে থাকা ওই নারী।

খাশোগির বাগদত্তা স্ত্রী হাতিস সেনগিজ রয়টার্সকে বলেন, কনস্যুলেটে প্রবেশের আগে দুটি মোবাইল ফোন খাশোগি তার হাতে দিয়ে যান। এসময় খাশোগি তাকে বলেন, ভেতর থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত যেন অপেক্ষা করেন হাতিস। এছাড়া যদি বের না হন তাহলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জ্যেষ্ঠ এক সহযোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যও বলে যান।

সৌদি ওই কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, কনসাল অফিসে ফেরার পর খাশোগি মুতরেবকে বলেন, তিনি কূটনৈতিক নীতি-নৈতিকতা লঙ্ঘন করছেন। এসময় খাশোগি বলেন, আপনি আমার সঙ্গে কী করতে যাচ্ছেন। আপনি কী আমাকে অপহরণ করতে চান? জবাবে মুতরেব বলেন, হ্যাঁ। আমরা তোমাকে ড্রাগ প্রয়োগ করবো এবং তুলে নিয়ে যাবো। এ ধরনের বাক-বিতণ্ডার কারণে সৌদির এই দলের উদ্দেশ্য বিফলে যায় এবং তারা আদেশ লঙ্ঘন করেন।

সৌদি আরবের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, খাশোগি চিৎকার শুরু করলে ভয়ের মধ্যে পড়ে যায় দলটি। তারা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং খাশোগির মুখে কাপড় ঢুকিয়ে চিৎকার থামানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। তারা চিৎকার থামানোর চেষ্টা করায় হীতে-বিপরীত হয়ে যায়। আর এতে শ্বাসরোধে মারা যান খাশোগি। কিন্তু আসলে তাকে হত্যার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।

খাশোগিকে কৌশলে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সৌদির ওই কর্মকর্তা বলেন, আপনি যদি জামালের মতো বয়সী কাউকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে রাখেন; তাহলে সম্ভবত তিনি মারা যাবেন।

এ ভুল কাজের জন্য দলের সদস্যরা খাশোগির মরদেহ একটি গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়। সেখান থেকে কনসুলেটের একটি গাড়িতে করে স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তরের পর মরদেহটি গুম করার নির্দেশ দেয়া হয়। কনস্যুলেটের ভেতরে এই হত্যাকাণ্ডের কোনো আলামত যেন খুঁজে পাওয়া না যায় সেজন্য ফরেনসিক এক্সপার্ট সালাহ তুবাইরি চেষ্টা করেন।

তুরস্কের সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, খাশোগির খুনীরা সম্ভবত তার মরদেহ ইস্তাম্বুলের কাছে বেলেগ্রেড জঙ্গলে পুঁতে রেখেছে। ইস্তাম্বুল থেকে ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণের ইয়ালোভা শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই জঙ্গলের অবস্থান। সৌদি ওই কর্মকর্তা বলেছেন, স্থানীয় যে ব্যক্তির সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল তিনি ইস্তাম্বুলের বাসিন্দা। তবে তার পরিচয় প্রকাশ হবে না। তিনি বলেন, খাশোগির মরদেহ শেষ পর্যন্ত কোথায় রয়েছে সেটি শনাক্তের চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা।

এদিকে, মুস্তফা মাদানির নামের এক কর্মকর্তা খাশোগির কাপড়, চশমা ও অ্যাপল ব্র্যান্ডের ঘড়ি পড়ে কনস্যুলেটের পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। খাশোগি ওই ভবন থেকে বেরিয়ে গেছেন এমন গল্প সাজানোর প্রচেষ্টা থেকে মাদানিকে খাশোগির পোশাক-সামগ্রী পরানো হয়। ভবন থেকে বেরিয়ে মাদানি চলে যান সুলতানাহমেত জেলায়। সেখানে পৌঁছে তার পোশাক এবং সঙ্গে থাকা অন্যান্য সামগ্রী ফেলে চলে যান।

পরে ওই দল সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছে একটি মিথ্যা প্রতিবেদন লিখে পাঠায়। এতে বলা হয়, খাশোগি যখন তাদের সতর্ক করে দেন যে, তুরস্ক কর্তৃপক্ষ এর সঙ্গে জড়িয়ে যেতে পারে। এমনকি ইস্তাম্বুল ত্যাগের আগে তাদের খুঁজে বের করতে পারবে বলেও সতর্ক করে দেন তিনি। এসময় তাকে কনস্যুলেট থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়।

কিন্তু সংশয়বাদীদের মনে সন্দেহ দানা বাঁধছে যে, যদি খাশোগিকে দেশে ফেরাতে রাজি করানোর জন্যই এরকম একটি দল পাঠানো হবে তাহলে সেই দলে কেন সামরিক কর্মকর্তা, ফরেনসিক এক্সপার্ট থাকবে।

সৌদির রাজপরিবারের এক সময়ের সুহৃদ সাংবাদিক জামাল খাশোগির নিখোঁজ ও খুনের ঘটনা দেশটির জন্য এখন ভয়াবহ এক সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। আর এই সঙ্কট মোকাবেলায় শেষ পর্যন্ত বাদশাহ সালমানকে মাঠে নামতে হয়েছে।

এদিকে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ ও কোম্পানির জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তারা রিয়াদে আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় সম্মেলন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছেন। সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে মার্কিন পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর চাপ তৈরি করেছেন।

সৌদির ওই কর্মকর্তা বলেছেন, স্থানীয় তিন সন্দেহভাজনসহ দলের ১৫ সদস্যের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে এং তদন্ত চলছে।

সূত্র : রয়টার্স।

এসআইএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।