ধনীদের শহর
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ধনী বসবাস করেন, সেরকম শীর্ষস্থানীয় ১০টি দেশের অর্ধেকই উন্নয়নশীল দেশের শহর। আর এসব দেশে সামাজিক বৈষম্য সবচেয়ে বেশি।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে বিশ্বে সম্পদের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। জরিপে দেখা যায়, ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে যারা ১০০ কোটি ডলার বা তার চেয়েও বেশি পরিমাণ অর্থের মালিক, তাদের সংখ্যা ২ হাজার ৭৫৪ জন।
তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন যা কীনা যৌথভাবে জার্মানি ও জাপানের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির চেয়েও বেশি।
হংকংয়ের অধিকাংশ মানুষই লি কা শিংয়ের কথা জানেন। নব্বই বছর বয়সী এই ব্যবসায়ী বিশ্বের ২৩তম ধনী ব্যক্তি। তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৮শ কোটি ডলার।
লি কা শিংয়ের যেসব ব্যবসা রয়েছে তার মধ্যে আছে পরিবহন থেকে শুরু করে আর্থিক সেবা এবং বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানী সরবরাহের মতো নানা ধরনের সার্ভিসও। কিন্তু বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েল্থ এক্স সম্প্রতি বিশ্বের শত কোটিপতিদের ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছে। তারা বলছেন, কা শিং ই হংকংয়ের একমাত্র শত কোটিপতি নন। তার মতো আরও অনেকেই আছেন।
ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমানে হংকং বিশ্বের এমন একটি দেশ যেখানে নিউ ইয়র্কের পরেই সবচেয়ে বেশি ধনী লোকের বসবাস। বর্তমানে এই শহরে থাকেন মোট ৯৩ জন বিলিওনিয়ার বা শত কোটিপতি যা ২০১৬ সালের তুলনায় ২১ জন বেশি।
শত কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে সমাজে তার কী ধরনের প্রভাব পড়ছে সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। একটি পক্ষ জোর দিচ্ছে এর ফলে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আয়ের বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার নৈতিকতার দিকটির ওপর।
আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফাম তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, এই বৈষম্য দূর করতে হলে অতি-বিত্তশালী লোকদের আয়ের ওপর আরো বেশি করে কর ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। কিন্তু আরেকটি পক্ষ বলছে, এই শত কোটিপতিরা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে এজেন্টের মতো ভূমিকা রাখছেন। অন্তত তাদের কেউ কেউ।
বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ ক্যারোলিন ফ্রয়েন্ড ২০১৬ সালে একটি বই লিখেছেন ‘ধনী ব্যক্তি: গরিব দেশ’ নামে।
বিবিসিকে তিনি বলেন, সব ধনী ব্যক্তিকে একই চোখে দেখলে হবে না। একটা প্রবণতা আছে যে বিত্তশালীরা সম্পদের অপব্যবহার করে থাকেন। নানাভাবেই সম্পদ গড়ে তোলা যায়। আর সেই সম্পদ কী ধরনের তার ওপরেও নির্ভর করে সমাজে তার কী প্রভাব পড়তে পারে।
তিনি আরো বলেন, যেসব ধনকুবের নিজের চেষ্টায় ধনী হয়েছেন, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, তাদের কাছ থেকে অন্যরা লাভবান হয়ে থাকেন। কিন্তু যারা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানার মাধ্যমে ধনী হয়েছেন তাদের মাধ্যমে সমাজে খুব একটা উপকার আসে না।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা সংক্রান্ত ম্যাগাজিন ফোর্বস বলছে, এই শত কোটিপতিরা এখন বিশ্বের ৭২টি দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। চীন, ভারত এবং হং কং-এ তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে।
এশিয়ার বিলিওনিয়ার ক্লাবে সদস্য সংখ্যা ৭৮৪। উত্তর অ্যামেরিকায় ৭২৭। এই প্রথম এশিয়ায় শত কোটিপতির সংখ্যা উত্তর আমেরিকার শত কোটিপতির সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চীনে ২০১৬ সালে মাত্র এক শতাংশ মানুষের কাছে যতো সম্পদ ছিল তার পরিমাণ দেশটির মোট সম্পদের এক তৃতীয়াংশ।
আর ২৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের কাছে ছিল মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ।
আফ্রিকাতে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা বর্তমানে ৪৪। তাদের মোট সম্পদের পরিমাণ ৯ হাজার ৩শ কোটি ডলার। বলা হচ্ছে, এসব ধনী ব্যক্তি যদি নিজেরা একটি দেশ গঠন করেন তাহলে তাদের দেশের জিডিপি হবে আফ্রিকার ৫৪টি দেশের তালিকার আট নম্বরে।
তাদের মাথাপিছু আয় ২১১ কোটি ডলার। কিন্তু আফ্রিকায় সাধারণ মানুষের মাথাপিছু আয় ২০১৭ সালে ছিল ১ হাজার ৮২৫ ডলার। ভারতেও বিত্তশালীদের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়েছে। নব্বই- এর দশকের মাঝামাঝি ফোর্বসে ধনীদের তালিকায় মাত্র দু’জন ছিলেন ভারতীয়। কিন্তু ২০১৬ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৪ জনে।
কিন্তু বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ২৮ কোটিরও বেশি মানুষ বাস করে দারিদ্রসীমার নিচে। অর্থনীতিবিদ ফ্রয়েন্ড বলছেন, যেসব দেশের খুব বেশি সম্পদ নেই সেসব দেশে বিত্তশালী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি, যারা কঠোর পরিশ্রম করে অল্প অর্থ উপার্জন করেন, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
কিন্তু দরিদ্র দেশে ধনী মানুষ ও ধনী কোম্পানির সংখ্যা বাড়লে সেটা ভালো অর্থনীতির ইঙ্গিত দেয়। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে জীবন-মানও উন্নত হয়। ফ্রয়েন্ড দেখিয়েছেন, চীনের নির্মাণ শিল্পে বড় বড় কোম্পানি গড়ে ওঠার কারণে শ্রমিকদের গড় মজুরি ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে তিনগুণ বেড়েছে। এসব কোম্পানিতে কাজ করছে প্রচুর মানুষ।
টিটিএন/পিআর