নারী দেহরক্ষীর গোপন জীবন
যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী দেহরক্ষী হিসেবে কাজ শুরু করেন এই নারী। দেশটির রাজপরিবারের সদস্য এবং অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের দেহরক্ষী হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। তার ৩০ বছরের পেশাজীবনে অনেক জিম্মিকে মুক্ত করেছেন আবার গোপনে নজরদারি করেছেন অনেককে। কিন্তু কেমন ছিল এই দেহরক্ষীর জীবন আসুন জেনে নেওয়া যাক।
দেহরক্ষী এই নারীর নাম জ্যাকুইন। ১৯৮০ সালে পুলিশে যোগদানের কিছুদিন পরেই জ্যাকুইন বেসরকারি নিরাপত্তা খাতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। এটা তাকে নানা ধরণের কাজের সুযোগ দেবে ভেবেই সেখানে যান তিনি। পেশার কারণে বিশ্বের নামীদামী পাঁচ বা ছয় তারকা হোটেলে থাকতে হয়েছে তাকে। তবে এই নারী বলেন নামীদামী হোটেলে থাকলেও প্রতিদিন ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করার পর সেসব আর উপভোগের সময় থাকত না।
তার কথায়, ‘যখন আমি প্রথম এই পেশায় আসি তখন এটা ছিল পুরোপুরি পুরুষ কেন্দ্রিক একটা জায়গা। তারা সবসময়ে চাইতো যে আমি যেনো শুধু নারী বা শিশুদের বিষয়গুলো দেখভাল করি। এ ব্যাপারটা ছিলো খুবই অদ্ভুত। মনে হতো যেন তারা প্রত্যেকেই আমার বাবা।’
জ্যাকুইন বলেন, ‘একজন দেহরক্ষীকে সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় তার ব্যক্তিগত জীবনের। এমনও হবে যে আপনি হয়তো আট-দশ সপ্তাহ বাড়িতেই যেতে পারবেন না। যখন আগেভাগে পরিকল্পনা করে ক্লায়েন্টদের জীবনের ঝুঁকি দূর করতে হয় তখন সেটি সিনেমা বা নাটকের চেয়েও নাটকীয় হয়ে ওঠে।’
অপহরণের শিকার কয়েকজন তেল কর্মীকে উদ্ধার করতে একবার ইরাকে গিয়েছিলেন। সেখানে নজরদারির অংশ হিসেবে ইরাকের রাস্তায় বোরকা পড়েও ঘুরতে হয়েছে তাকে।
বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের বিজনেস ডেইলির কাছে একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে জ্যাকুইন বলেন, ‘একবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ধাওয়া করলে আমরা কাশ্মিরে ঢুকে পড়ি। কাশ্মিরের বিদ্রোহীরা পাকিস্তানি সেনাদের দিকে গুলি ছোড়া শুরু করলে আমরাও তার মধ্যে পড়ে যাই।’
সদ্য বিবাহিত স্বামীর সঙ্গে পাকিস্তানে যাওয়া ২৩ বছর বয়সী একজন ব্রিটিশ নারীকে উদ্ধার করতে নিজের দল নিয়ে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন জ্যাকুইন। ব্রিটেনে বসবাসরত ওই নারীর মা জানতে পারেন যে, পাকিস্তানে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। তখন তিনি মেয়েকে উদ্ধারের জন্য জ্যাকুইনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যে বাড়িতে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল একরাতে জ্যাকুইন সেখানে প্রবেশ করে তাকে বিছানার সঙ্গে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় দেখতে পান।
সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জ্যাকুলিন বলেন, ‘মেয়েটি ছিলো তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। এমনকি তাকে খেতে দেওয়া হচ্ছিল না। প্রতিনিয়ত মারধর করা হতো। আমি তখন তাকে বললাম যে, আমি আবার আসবো এবং তোমাকে নিয়ে যাবো। কিন্তু হঠাৎ একটি ফোন কলে তারা জানতে পারেন যে তাদের পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘বেনজির ভুট্টোর জন্য আমি একসময় কাজ করেছি। তিনি আমাকে চিনতে পারেন এবং ধারণা করেন নিশ্চয়ই আমি কাউকে উদ্ধার করার জন্য এখানে এসেছি। এর মানে, তাদের খুব দ্রুত কাজ করতে হবে। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ঘুষ দিয়ে আমরা বাড়িটির গেট ভেঙ্গে প্রবেশ করি। এরপর সেই মেয়েটিকে উদ্ধার করে পাহাড়ি পথ ধরে একটা গাড়িতে করে ভারতের উদ্দেশে রওনা দেই। কিন্তু পথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ধাওয়া করে। এরপর ভারত হয়ে সেই মেয়েকে ব্রিটেনে ফিরিয়ে নিয়ে আসি।’
জ্যাকুইন বলছেন, গত ৩০ বছরে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেক নারী এই পেশায় আগ্রহী হয়ে উঠেছে, যদিও পুরো যুক্তরাজ্য জুড়ে নারী দেহরক্ষীর সংখ্যা এখনো মাত্র ১০ জন। দেহরক্ষী হিসাবে যারা কাজ করবেন, তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে তারা ক্লায়েন্টের বন্ধু নন। আর এটা ভাবতে পারলেই আপনার দৃষ্টি পরিষ্কার থাকবে। তাই যখন প্রয়োজন হবে তখন আপনি ঠিক পদক্ষেপটা নিতে পারবেন।’
তিনি বলেন, দেহরক্ষী বলতে যেরকম কালো চশমা পড়া কাউকে আমরা ভেবে বসি বাস্তবে সেটা নাও হতে পারে। বরং তার পোশাকের চেয়ে মস্তিষ্ক অনেক বেশি খাটাতে হয়। তাকে নামীদামী রেস্তোরায় ক্লায়েন্টের সঙ্গে বসে খেতে হয়। বিখ্যাত ক্লাবে বিকালের নাস্তায় ঠিক পোশাকে এবং আদবকায়দার সঙ্গে চা খেতে হয়। বিশ্বের চলমান নানা বিষয়ে কথা বলার জন্য খোঁজখবর রাখতে হয়।
তবে এই পেশার ঝুঁকির বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না জ্যাকুইন। কিন্তু তিনি এটাও বলেন কোন চাকরি নিয়েই তো আর উদ্বেগে থাকা যায় না। জ্যাকুইন ডেভিসের এই জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র বানানোর পরিকল্পনা করছে মার্কিন বিনোদনধর্মী প্রতিষ্ঠান নেটফ্লিক্স।
এসএ/টিটিএন/আরআইপি