ক্যাপ্টেন আবিদের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা নেপালের
কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিএসএস-২১১ বিধ্বস্তের ঘটনায় বিমানটির পাইলট আবিদ সুলতানের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে নেপালি গণমাধ্যম দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট। বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা তদন্তে গঠিত নেপাল সরকারের তদন্ত এখনো শেষ না হলেও তদন্তের একটি কপি হাতে পাওয়ার দাবি করে নেপালি এই দৈনিক বলছে, গত মার্চে বিধ্বস্ত ওই বিমানের পাইলট আবিদ সুলতান ত্রিভুবনে বিমান অবতরণের ব্যাপারে বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ‘অসত্য’ তথ্য দিয়েছিলেন।
‘ঢাকা থেকে কাঠমান্ডুর ত্রিভুবনে বিমানের এক ঘণ্টার পথে ককপিটের ভেতরে অনবরত ধূমপান করছিলেন পাইলট আবিদ সুলতান।’ তদন্ত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে কাঠমান্ডু পোস্ট বলছে, ‘এই এক ঘণ্টার পথে ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান ভয়াবহ ব্যক্তিগত মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন এবং ধারাবাহিকভাবে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন; যে কারণে ফ্লাইট বিএস২১১ বিধ্বস্ত হয়।’
চলতি বছরের ১২ মার্চ বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিএস২১১ ঢাকা থেকে ৭১ আরোহী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। পরে নেপালের কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। এতে ৫১ আরোহীর প্রাণহানি ঘটে। এদের মধ্যে ২৮ জন বাংলাদেশি, ২২ জন নেপালি ও একজন চীনা নাগরিক।
নেপাল ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতানের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করলেও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘বিএস-২১১ ফ্লাইটের উড়োজাহাজে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। পাইলট ক্যাপ্টেন আবিদ সুলতান শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন।’
‘নেপাল সরকারের তদন্ত প্রতিবেদন শেষ হওয়ার আগেই দেশটির গণমাধ্যমে বিমান বিধ্বস্তের জন্য পাইলটকে দায়ী করে যে খবর প্রকাশ করা হয়েছে তা ‘ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট’। এর মাধ্যমে তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে পারে’ বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার কামরুল ইসলাম।
কাঠমান্ডু পোস্ট বলছে, নেপালি তদন্তকারীরা প্রতিবেদনে বলেছেন, বিমান পরিচালনার পুরো সময়জুড়ে আবিদ সুলতান অস্বাভাবিক আচরণ করেছিলেন, যে কারণে দ্রুত লাল পতাকা উত্তোলন করা উচিত ছিল।
বিমানটি অবতরণের ছয় মিনিট আগে আবিদ সুলতান নিশ্চিত করেছিলেন যে, বিমানের অবতরণ গিয়ার নিচে নেমে গেছে এবং লক হয়েছে। বিমানের ককপিটের ইলেকট্রিক নির্দেশক লাইটের উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাইলট বলেছিলেন, গিয়ার নিচে নেমেছে এবং তিনটি সবুজ বাতি জ্বলেছে।’
আরও পড়ুন : পাইলটকে ভুল বার্তা দেয়ায় বিমান বিধ্বস্ত
এসময় বিমানের কো-পাইলট পৃথুলা রশিদ বিমান অবতরণের জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা করেন, তখন তিনি দেখতে পান ল্যান্ডিং গিয়ার নিচে নামেনি। এর কয়েক মিনিট পরে দ্বিতীয় অবতরণ চেষ্টার সময় ৬৭ যাত্রী ও চার ক্রুবাহী বিমানটি রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়লে আগুন ধরে যায়।
নেপালের তদন্তকারীরা বলেছেন, ‘ঢাকা থেকে কাঠমান্ডুগামী এক ঘণ্টার পথে বার বার ধূমপান করছিলেন সুলতান।’ বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সাবেক এই পাইলট; যিনি ৫ হাজার ৫০০ ঘণ্টার বেশি বিমান উড্ডয়ন করেছিলেন, তিনি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে তার ধূমপানের ব্যাপারে অবগত করেননি। তদন্তকারীরা এই বিষয়টি ধরে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ককপিটের ভেতরে থাকাকালীন আবিদ সুলতান মারাত্মক মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন।
প্রতিবেদনে তদন্তকারীরা বলেছেন, ‘ককপিট ভয়েস রেকর্ডারের কথোপকথন বিশ্লেষণের সময় এটা পরিষ্কার হয়েছে যে, প্রচণ্ড মানসিক চাপ সামলে নেয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন আবিদ। এছাড়া কম ঘুমের কারণে তাকে ক্লান্ত এবং অবশাদগ্রস্ত মনে হয়েছে। ককপিটে থাকাকালীন বেশ কয়েকবার কান্না করেছিলেন তিনি।’
আরও পড়ুন : বিমান বিধ্বস্তের অফিসিয়াল স্কেচ কী বলছে?
ককপিটের ভয়েস রেকর্ডারে পাইলট ও কো-পাইলটের কথোপকথনের এক ঘণ্টার রেকর্ড পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এতে ফ্লাইট পরিচালনার পুরো সময়জুড়ে চিন্তিত এবং পরিস্থিতিগতভাবেও আবিদ সচেতন ছিলেন না বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এদিকে, বিমান বিধ্বস্তের পেছনে পুরো দায় পাইলট আবিদ সুলতানের ওপর চাপালেও ত্রিভুবন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) টাওয়ার থেকে প্রায়ই ভুল এবং বিভ্রান্তিকর বার্তা দেয় ত্রিভুবনের এটিসি টাওয়ার অবতরণের ভুল নির্দেশনা দেয়ার অতীত নজির রয়েছে। নেপালের ইংরেজি দৈনিক নেপালি টাইমস বিমান বিধ্বস্তের পরপরই (১২ মার্চ, ২০১৮) বিমানবন্দরের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে পাইলটের সর্বশেষ কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড প্রকাশ করে। নেপালি এ দৈনিক ওইদিন তাদের প্রতিবেদনে জানায়, কন্ট্রোল রুম থেকে ভুল বার্তা দেয়ার কারণেই ককপিটে দ্বিধায় পড়েন পাইলট আবিদ।
অডিও রেকর্ডের শুরুতে শোনা যায়, কন্ট্রোল রুম থেকে বিমানের পাইলটকে বিমানবন্দরের ডানদিকের দুই নম্বর রানওয়েতে অবতরণের নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। পরে পাইলট বলেন, ঠিক আছে স্যার। নির্দেশনা অনুযায়ী পাইলট বিমানটি বিমানবন্দরের ডানদিকে নিয়ে যাওয়ার কথা জানান কন্ট্রোল রুমে।
কিন্তু ডানদিকে রানওয়ে ফ্রি না থাকায় পাইলট আবারো কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ সময় তাকে ভিন্ন বার্তা দেয়া হয়। এবারে প্রশ্ন করা হয়, আপনি কি বর্তমান অবস্থানে থাকতে পারবেন? এ সময় পাইলট দুই নম্বর রানওয়ে ফ্রি করার জন্য কন্ট্রোল রুমের কাছে অনুরোধ জানান। কিন্তু তাকে আবারো ভিন্ন বার্তা দেয়া হয়।
এর কিছুক্ষণ পর পাইলট বলেন, স্যার আমি আবারো অনুরোধ করছি রানওয়ে ফ্রি করুন। এর পরপরই বিমানটি বিকট শব্দ করতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরই বিমানটি ত্রিভুবন বিমানবন্দরের পাশের একটি ফুটবল মাঠে আঁছড়ে পড়ে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছয় কর্মকর্তাকে পরদিন (১৩ মার্চ) ত্রিভুবন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের কার্যালয় থেকে বদলি সরিয়ে দেয়া হয় ত্রিভুবন বিমানবন্দরের ৬ কর্মকর্তাকে।
বিমানের নিরাপত্তার সঙ্গে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। শুধু এটিসি টাওয়ারই নয়; দেশটির আবহাওয়া বিভাগও (ডিএইচএম) নেপালের আবহাওয়া-সংক্রান্ত ভুল তথ্য অনেক সময় প্রকাশ করে।
পাইলটদের কাছে নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এটিসি টাওয়ারের ভুল বার্তার ব্যাপারে ২০১৬ সালের ২৮ মার্চ দেশটির অপর ইংরেজি দৈনিক দ্য হিমালয়ান টাইমস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটিসি টাওয়ার থেকে প্রায়ই পাইলটদের কাছে এ ধরনের ভুল বার্তা দেয়া হয়।
ওই সময় হিমালয়ান টাইমসকে বিমানের একাধিক পাইলট জানান, তারা প্রায়ই এটিসি টাওয়ার থেকে আবহাওয়া-সংক্রান্ত ভুল বার্তা পান। ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এটিসি টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগের কথা স্মরণ করে জ্যেষ্ঠ এক পাইলট বলেন, ‘টাওয়ার থেকে জানানো হয় যে, আজ সকালে বিমানবন্দরের দৃষ্টিসীমা তিন কিলোমিটার। কিন্তু কাঠমান্ডু কুয়াশায় ঢেকে যাওয়ায় ডিএইচএমের তথ্য সে সময় জানায় বিমানবন্দরের দৃষ্টিসীমা দেড় কিলোমিটারের কম।’
এটিসি টাওয়ারের এমন ভুল তথ্য দেয়ার নজিরকে পাশ কাটিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউএস-বাংলা ফ্লাইট ২১১ বিধ্বস্তের ঘটনায় তদন্তকারীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, বিমানটিকে দিক নির্দেশনা দেয়া ও বিধ্বস্তের পেছনে এটিসির উল্লেখযোগ্য কোনো গাফিলতি ছিল না।
নেপাল সরকারের তদন্ত দলে থাকা বাংলাদেশের প্রতিনিধি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন কনসালটেন্ট সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদনকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা সম্পূর্ণ ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য। এমন কোনো কিছুই এখনো তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসেনি।
এসআইএস/আরআইপি