বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকটের গল্প বললো এইডস সম্মেলন

মহিউদ্দিন সরকার
মহিউদ্দিন সরকার মহিউদ্দিন সরকার আমস্টারডাম, নেদারল্যান্ডস থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ০৭:৪১ পিএম, ৩১ জুলাই ২০১৮

এইডস নির্মূলের লক্ষ্যে নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডামে ২২তম আন্তর্জাতিক এইডস সম্মেলন হয়ে গেল গত ২৩ থেকে ২৭ জুলাই। তারকাপূর্ণ এই সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয়ের উপস্থাপনা, প্যানেল আলোচনা, এইডসের প্রকোপ বৃদ্ধির ঝুঁকি ও নির্মূলে বিভিন্ন ধরনের সংকটের চিত্র উঠে এসেছে।

প্রাণঘাতী এই রোগের বিস্তার নিয়ে এখনো শঙ্কা রয়ে গেলেও এবারের সম্মেলনে এইডস নির্মূলে নতুন নতুন আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার এসেছে। তবে কীভাবে এইচআইভির প্রকোপ ঠেকানো যায় সে ব্যাপারে বেশ উচ্চবাচ্য পাওয়া গেলেও রয়েছে বেশ কিছু প্রশ্ন।

ডাচ রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের এই এইডস সম্মেলনে বিশ্বের ১৬০টিরও বেশি দেশের ১৬ হাজারের বেশি প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। চলতি বছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সূচিতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল বৃহৎ পরিসরের। এতে সাম্প্রতিক এইচআইভি নিয়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা, নীতিমালা ও কর্মপরিকল্পনার ওপর অনুষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অধিবেশন।

jagonews24

সপ্তাহব্যাপী এই সম্মেলনে বিনোদন দুনিয়ার তারকা এল্টন জন, চার্লিজ থেরনের পাশাপাশি অংশ নিয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রিন্স হ্যারি। ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন; সমাপনী অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন তিনি।

২২তম এই সম্মেলনে বিশ্বের প্রধান প্রধান স্বাস্থ্য সংস্থা ও দাতব্য সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এমারজেন্সি প্ল্যানস ফর এইডস রিলিফ, গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস, টিউবারকিলোসিস অ্যান্ড ম্যালেরিয়া, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের এইচআইভি/এইডসবিষয়ক যৌথ কর্মসূচির প্রতিনিধিরা।

‘ব্রেকিং ব্যারিয়ারস, বিল্ডিং ব্রিজেস’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে এইচআইভি/এইডস মহামারী যে সঙ্কট রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে সেই গল্প উঠে এসেছে। গত বছর প্রাণঘাতী এই রোগে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ। ইউএনএইডসের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের কিশোরী, পূর্ব ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের মাদকসেবীদের মাঝে এর প্রকোপ বিপজ্জনক মাত্রায় বাড়ছে।

jagonews24

একই সময়ে ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড এভালুয়েশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এইডস নির্মূলের লড়াইয়ে দাতা সংস্থাগুলোর আর্থিক সহায়তা অন্তত তিন বিলিয়ন ডলার কমেছে।

এবিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এইচআইভি প্রতিরোধ ও নিরীক্ষাবিষয়ক সমন্বয়ক রাসেল বাগালের সঙ্গে কথা হয় আমস্টারডামে। তিনি বলেন, ‘আগের সম্মেলনে যে সাড়া পাওয়া গিয়েছিল এবারে সেরকম পাওয়া যায়নি। তবে এটা দেখে ভালো লাগছে যে, এইডস মোকাবেলায় বিশ্ব সম্প্রদায় জোরের সঙ্গে কাজ করছে।’

‘এটা খুব ইতিবাচক যে, এইডস আন্দোলন এখনো ফুরিয়ে যায়নি... এখানে অনেক কিছুই করার আছে এবং আমাদের অবশ্যই সেসব করতে হবে। এখনো অনেক মানুষ আছেন যারা এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন।’

যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইডসের নির্বাহী পরিচালক মাইকেল সিদিবে ব্যবস্থা না নেয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েন। সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনের অনুষ্ঠানে সিদিবের বক্তব্য দেয়ার সময় ২০ জনেরও বেশি নারী সিদিবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখান। ওই নারীরা তার পদত্যাগের দাবি তুললেও তিনি তা নাকচ করে দেন।

jagonews24

সম্মেলনে ছেলে এবং মেয়েদের জন্য এইচআইভি সেবায় যুক্তরাজ্যের মেনস্টার জোট ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ও তৃণমূলের এইচআইভি আক্রান্তদের জন্য রবার্ট কার ফান্ডের মাধ্যমে ৬০ লাখ ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে ব্রিটিশ সরকার। তবে মূল পরীক্ষা হবে আগামী বছর; যখন ফ্রান্সে বৈশ্বিক এই তহবিলের পুনর্মূল্যায়ন করা হবে।

তরুণ এইচআইভি কর্মী মার্সি এনগুলুবে বললেন, আমরা সবাই একটি সেতুবন্ধন তৈরি করতে যাচ্ছি... কিন্তু এই সেতু আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? এই সেতুকে এমন হতে দেয়া যাবে না যার কোনো গন্তব্য নেই। তবে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা একটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন, সামনের দিনগুলোতে যদি সঠিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব না হয় তাহলে এইচআইভির মহামারী দেখবে বিশ্ব।

প্রত্যেক বছর প্রায় ১৮ লাখ মানুষের শরীরে নতুন করে এইচআইভির সংক্রমণ ঘটছে। এইচআইভির চিকিৎসায় নানাবিধ অগ্রগতি হলেও এই ভাইরাসের নিশ্চিত প্রতিষেধক এখনও মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। প্রেপ বা প্রি এক্সপোজার প্রোফাইল্যাক্সিস নামের ওষুধটি এইচআইভি সংক্রমণ রোধে কার্যকর এবং নিয়মিত সেবন করতে হয়।

আক্রান্ত হওয়ার আগে নিয়মিত এই ওষুধ গ্রহণ করলে এইচআইভি সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে না। এইচআইভি ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করার পর দেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকতে পারে, যা এই ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরির পেছনে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে করা হয়।

jagonews24

ইউনিসেফ বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে নতুন করে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী অন্তত ৯ কোটি ৬০ লাখ জনগোষ্ঠী এইডসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের দুই-তৃতীয়াংশই হবেন কিশোরী অথবা তরুণী। তরুণ জনগোষ্ঠীর মাঝে এইচআইভি আক্রান্তের চলমান ধারা ওই অঞ্চলে এইডসের প্রকোপের চিত্র তুলে ধরেছে।

তবে এবারের সম্মেলনে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পাশাপাশি ইউরোপের পূর্বাঞ্চল, এশিয়া ও মধ্য এশিয়ায় এইচআইভির প্রকোপ ও আক্রান্তদের কাছে দাতাসংস্থা ও সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর পৌঁছানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

এসআইএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।