দুই ঘণ্টায় মেলে যেকোনো সার্টিফিকেট!


প্রকাশিত: ০৩:১২ পিএম, ০৬ আগস্ট ২০১৫

ভর্তিযুদ্ধের ঝামেলা নেই। নেই চার-পাঁচ বছর কষ্ট করে পড়া-লেখা করার বিড়বম্বনাও। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিদেশ গিয়ে বাবার পকেটের লাখ টাকা ব্যয়ের ঝুঁকিও নেই। দরকার শুধু নগদ কয়েক হাজার টাকা। মিলে যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশ-বিদেশের সকল পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট!

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেট এবং গাউসুল আযম মার্কেটের নির্দিষ্ট কয়েকটি দোকানে তৈরি করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, ব্যাংক সার্টিফিকেট, বিভিন্ন এনজিও ও সংস্থা পদত্ত সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ প্রয়োজনীয় সকল ডকুমেন্টারি।

দেখে কোনো ভাবেই বোঝা উপায় নেই এসব নকল সার্টিফিকেট। এ কাজে যে কাগজগুলো ব্যবহার করা হয় তাও স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত মূল কাগজ। তফাৎ শুধু এতটুকু যে সার্টিফিকেটগুলো বিশ্ববিদ্যালয়সহ স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের রেকর্ডে নেই। আবার দোকান মালিকদের কাগজগুলো সংগ্রহে সহযোগীতা করছেন আড়ালে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা-এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।

আর এতে করে বিন্দু মাত্র একাডেমিক যোগ্যতা না থাকলেও শত শত মানুষ নিজের ইচ্ছে মতো টাকার বিনিময়ে তৈরি করে নিচ্ছেন জাল সার্টিফিকেট। যার মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগও পাচ্ছেন হরহামেশায়। তাই তো একটি বাক্যও সব সময় শোনা যায় ‘রাজধানীর নীলক্ষেতে পাওয়া যায় না এমন কিছু নেই’!

সূত্র জানায়, জাল সার্টিফিকেট সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্য শুধু নীলক্ষেতেই সীমাবদ্ধ নেই। ঢাকা শহরের আরো বেশ কিছু জায়গাতেও তারা সক্রিয়। বিভিন্ন কৌশল আর প্রযুক্তির ব্যবহার করে তারা সার্টিফিকেট তৈরির এই অসাধু কাজ করে যাচ্ছে। যে কাজগুলো দিনের চেয়ে বেশি রাত্রি বেলাই সম্পন্ন হয়ে থাকে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে।

রাত ৮টায় মার্কেট বন্ধ হওয়ার পর অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে চলে এ রমরমা ব্যবসা। অন্যদিকে প্রশাসনসহ অনেকে এই ব্যাপারে জানলেও চক্রটি নিয়মিতই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এদিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত বুধবার দুপুরে নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে অভিযান চালান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের নেতৃত্বে নিউ মার্কেট থানা পুলিশ। তাদের অভিযানে ওই মার্কেটের ‘মায়ের দোয়া উদয়ন প্রিন্টার্স’ এর মালিক আজগর ভূঁইয়াসহ ২ দোকান মালিককে আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে নকল সার্টিফিকেট তৈরির বেশ কিছু সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়। যেখানে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সার্টির্ফিকেট, দেশি-বিদেশি কয়েকটি পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট জাল করার অর্জিনাল কাগজ ও ৭৭টি প্লেটসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি।

এ সময় তারা তাদের কাজে সহযোগিতাকারী হিসেবে আরো ১৪ জন দোকান মালিকের কথা উল্লেখ করেন। সেখানে রয়েছে বাকুশাহ মার্কেটের ১নং গলির ফিরোজের দোকানসহ কয়েকটি দোকানের নাম।

এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাদি হয়ে আটকদের নামে নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আমজাদ আলী জাগো নিউজকে জানান, ‘এদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান সিকিউরিটি অফিসারের মাধ্যমে নিউ মার্কেট থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। তবে মামলার কপি এখনো আমার কাছে এসে পৌঁছায়নি। যার কারণের মামলা নম্বর বলা যাচ্ছে না।`

নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটের ভিতরের গলিতে প্রবেশ করলে দেখা যায় এখানে রয়েছে ভিজিটিং কার্ড, ক্যাশমেমো, প্যাড, পোস্টার, ক্যালেন্ডারসহ বিভিন্ন ব্যানার তৈরির দোকান। আর এই দোকানগুলোই তাদের ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন যাবৎ চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ সার্টিফিকেট ও আইডি কার্ডসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরির কাজ। যেগুলোর মধ্যে ‘মায়ের দোয়া উদয়ন প্রিন্টার্স’ এর মালিক ধরা পড়লেও এখনো বাকি রয়েছে অন্যরা। যারা ২ হাজার থেকে শুরু করে ৮-১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে এই পরিমাণ  ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত যায়।

জানা গেছে, জাল সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন আইডি কার্ড তৈরিতে কম্পিউটার দোকানগুলো বিশেষ কিছু পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এ কাজে নিয়োজিতদের প্রত্যেকের কম্পিউটারে বেশকিছু সার্টিফিকেট ও কার্ডের নমুনা থাকে। গ্রাহকের চাহিদা মতো তারা এসব মডেল দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করেন।

সার্টিফিকেট জালের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আমজাদ আলী আরো বলেন, ‘আমরা পুলিশকে বলেছি তাদের (আটকদের) যেন ১৬৪ ধারায় রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ এর সাথে জড়িত কিনা বের করা সম্ভব হবে।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি মনে করি এর সাথে কারা জড়িত তা বের করা সম্ভব। এর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

উপাচার্য এর তথ্য উদঘাটনে অনুসন্ধান মূলক সাংবাদিকতা করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বানও জানান।
 
তিনি আরো বলেন, ‘জাল সার্টিফিকেটে যে কাগজগুলো ব্যবহার করা হয়। তা তো দেশে পাওয়া যায় না। নিশ্চয় এর সাথে প্রাশাসনিক কেউ জড়িত। কেউ জড়িত প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এমএইচ/এসকেডি/আরএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।