ভারতীয় সেক্স গুরুর দেহরক্ষী ছিলেন যে স্কটিশ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:০৯ পিএম, ০৫ জুন ২০১৮

ভারতীয় যৌন গুরু শ্রী রাজনীশের প্রথম দিকের শিষ্য হিউ মিলন্'র স্বপ্ন ছিল ভালবাসা ও উদারতার উপর ভিত্তি করে একটি আলোকিত সমাজ গড়া। কিন্তু তার এই স্বপ্নভঙ্গ হয় আশাতীতভাবে। জনপ্রিয় নেটফ্লিক্স সিরিজ ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড কান্ট্রিতে উঠে আসে ভগবান রাজনীশের চমকপ্রদ কিন্তু বিতর্কিত জীবনকাহিনী।

ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন রাজ্যের ৬৪ হাজার একর এলাকাজুড়ে এক খামারে হাজার হাজার শিষ্য নিয়ে ছিল রাজনীশের আশ্রম। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে নানা ধরণের আইনি জটিলতাসহ হত্যাচেষ্টা, নির্বাচনে কারচুপি, অস্ত্র চোরাচালানের মত নানান বিতর্ক তৈরি হয়।

১৯৮৪ সালে বড় মাপের একটি বিষপ্রয়োগের ঘটনাও ঘটে সেখানে, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জৈব-সন্ত্রাসমূলক ঘটনা বলে মনে করা হয়।

রহস্যজনক এই ব্যক্তির সাহচর্যে - যার ৯০টি রোলস রয়েস আছে বলে মনে করা হয় - প্রায় এক দশক কাটান এডিনবারা'র হিউ মিলন্। এই সময়ে রাজনীশ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন, তার মেয়েবন্ধুর সাথে সহবাস করেন এবং হিউকে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করেন।

রাজনীশের দেহরক্ষী হিসেবে বেশ কয়েকবছর দায়িত্বপালন করেন হিউ। সেসময় তার প্রধান কাজ ছিল অনুসারীরা যেন ভগবান রাজনীশের দেহ স্পর্শ করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। হিউ রাজনীশের সাথে থাকার সময়কালীন ১০ বছরে রাজনীশের ভক্ত সংখ্যা ২০ থেকে ২০ হাজার এ উন্নীত হয়।

হিউ বলেন, এই অনুসারীদের মধ্যে অধিকাংশই ঘরবাড়ি, পরিবার, কাজ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে সপ্তাহে ৬০ থেকে ৮০ ঘণ্টা কাজ করতো এবং আশ্রমে থাকতো। এটি এমনই এক অঙ্গীকার ছিল।

স্কটল্যান্ডের লানার্কে জন্ম নেয়া হিউ মিলন্'র বেড়ে ওঠা এডিনবারায়। এডিনবারায় কিংস্টন ক্লিনিকের সাথে যুক্ত ছিল হিউর পরিবার। হিউর পিতামহ জেমস সি থম্পসন ছিলেন ক্লিনিকটির প্রতিষ্ঠাতা যিনি হাইড্রোথেরাপি ব্যবহার করে চিকিৎসা পদ্ধতির বিস্তার করেছিলেন।

রাজনীশের অডিও ক্যাসেট শুনে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৭৩ সালে অস্টিওপ্যাথ হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষে ভারত যান ২৫ বছর বয়সী হিউ। এরকম অসাধারণ একজন ব্যক্তির সাথে পরিচয় হওয়ার পর নিজের অস্তিত্বের ওপর তার ব্যাপক প্রভাব পড়বে। আমার তাঁকে মনে হয়েছিল অসাধারণ, জ্ঞানী,উদার, সংবেদনশীল একজন চরিত্র হিসেবে।

ভারতে থাকাকালীন হিউ পরিচিত ছিল স্বামী শিবমূর্তি হিসেবে। রাজনীশকে নিয়ে হিউ'র লেখা বই দ্য গড দ্যাট ফেইলড এ তিনি বলেছেন খ্রিস্টীয় মতবাদ বিচার করলে কোনো দিক থেকেই তিনি ঈশ্বরের মত ছিলেন না।

হিউ বলেন, আমার দৃষ্টিতে তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যার মানুষকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। হিউ'র মতে রাজনীশ, যিনি ১৯৯০ সালে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে ওশো নাম নেন, একজন বহুরূপী ছিলেন যিনি মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে তাদের কাছে উপস্থাপন করতে পারতেন।

হিউ বলেন, প্রথমদিকে তার সাথে রাজনীশের বৈঠক, যেগুলোকে দর্শন বলা হতো, খুবই আমোদপূর্ণ ছিল। প্রথম ১৮ মাসের মধ্যেই ভগবান রাজনীশ হিউর মেয়েবন্ধুর সাথে সহবাস শুরু করেন এবং হিউকে ভারতের উষ্ম একটি অঞ্চলের এক খামারে কাজ করতে পাঠিয়ে দেন।

হিউ বলেন, ওই সময় রাজনীশের বয়স ছিল চল্লিশের কিছু বেশি। রাজনীশ তার নারী অনুসারীদের সাথে ভোর ৪টায় বিশেষ দর্শন দিতেন বলে জানান হিউ। তাকে সেক্স গুরু উপাধি দেয়া হয়েছিল কারণ তিনি যৌনতা বিষয়ে তার ভাষণে ও বক্তৃতায় অনেক কথা বলতেন এবং তিনি যে তার নারী অনুসারীদের সাথে সহবাস করেন তা সর্বজনবিদিত ছিল।

হিউ বলেন যে একপর্যায়ে তিনি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন ও আশ্রম ত্যাগ করার কথা চিন্তা করেন। তবে শেষপর্যন্ত তিনি আশ্রম না ছেড়ে সেখানে থেকে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন।

যৌনতার দিক থেকে আমরা সবাই ছিলাম মুক্ত। সেখানে খুব কম মানুষই একগামী ছিল। ১৯৭৩ সালে এটিকে ভিন্নভাবে দেখা হতো। হিউ বলেন, বিশেষ দর্শনের পর তার বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক নতুন রূপ পায়। তবে এর কিছুদিন পরই রাজনীশ তাকে ৪০০ মাইল দূরের একটি খামারে কাজ করতে পাঠিয়ে দেয়।

ফিরে আসার পর রাজনীশের ব্যক্তিগত সচিব মা যোগলক্ষ্মী'র দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ পান। ভক্তদের কাছে আসতে না দেয়ার ব্যাপারে ভগবান রাজনীশ কিছুটা বিব্রত থাকলেও তিনি মানুষের ছোঁয়া সহ্য করতে পারতেন না বলে জানান হিউ।

পরের সাত বছর হিউ রাজনীশের দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করেন। অনুসারীদের আরেকটি গোষ্ঠী ছিল মা আনন্দ শীলা কেন্দ্রিক। নেটফ্লিক্স ডকুমেন্টারির ওরেগন সম্প্রদায়ের একজন প্রধান চরিত্র হিসেবে তাকে দেখানো হয়েছে।

শীলা ভারতীয় নাগরিক হলেও নিউ জার্সিতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ভারতে ভগবান রাজনীশের সাথে যোগ দেয়ার আগে একজন আমেরিকান নাগরিককে বিয়ে করেন। হিউ জানান, পুনেতে আশ্রমের ক্যান্টিনে কাজ করার সময় শীলার সাথে কাজ করেছিলেন তিনি।

হিউ বলেন, সেসময় মাস খানেকের জন্য শীলার সাথে তার গভীর প্রণয় গড়ে উঠেছিল। শীলার স্বামী রাজনীশকে জানানোর পর তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়। এই সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর হিউ'র প্রতি শীলার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয় এবং শীলা দ্রুত আশ্রমের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়। একসময় লক্ষ্মীকে ছাড়িয়ে রাজনীশের ব্যক্তিগত সচিব হয় শিলা।

ভারতে বিতর্কের জন্ম দেয়া শুরু করলে আশ্রমের জন্য নতুন জায়গা খুঁজতে শুরু করেন রাজনীশ। যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনে চলে যাওয়ার পেছনে শীলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮১ সালে ওরেগনের একটি খামার কিনে নেন শীলা এবং রাজনীশের মতাদর্শ অনুযায়ী নতুন একটি শহর তৈরি করতে আশ্রমের সন্ন্যাসীদের নিয়োগ দেন।

হিউ বলেন, আমার মতে, ওরেগনে যাওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। শুরু থেকেই স্থানীয় আইন ভঙ্গ করে ওরেগন আশ্রমের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল বলে জানান হিউ। শীলা ও তার অনুসারীদের কয়েকজন কিন্তু তাদের পরিকল্পনা-মাফিক কাজই করছিল।

তারা পার্শ্ববর্তী অ্যান্টেলপ এলাকার মানুষজনকে ভয় দেখানো ও হয়রানিমূলক কাজও করতে থাকে। একপর্যায়ে রাজ্য সরকারের কর্মকর্তাদের হত্যার প্রচেষ্টাও চালায় তারা।

একটি নির্বাচনে কারচুপি করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় একটি রেস্টুরেন্টের সালাদে বিষ মেশানো হয়। এর ফলে ৭৫০ জনের বেশী মানুষের মধ্যে সালমোনেলা সংক্রমণ হয়। রাজনীশের লোকজন দাবী করে যে তারা কর্তৃপক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার। তবে হিউ'র মতে, আইনের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করার ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছিল।

হিউ বলেন, ১৯৮২ সালের দিকে এই সম্প্রদায়ের ওপর থেকে ভক্তি উঠে আসতে শুরু করে তার। আশ্রম গড়ে তোলার জন্য সপ্তাহে ৮০-১০০ ঘণ্টা কাজ করতে থাকা সন্ন্যাসীরা ধীরে ধীরে সরে পড়ছিল। এই সময় আশ্রমের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অস্টিওপ্যাথ হিসেবে কাজ করছিলেন হিউ।

হিউ বলেন, শীলার অমানুষিক নির্দেশ অনুযায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা ব্যক্তিদের চিকিৎসা করা হতো। তাদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর না দিয়েই জোরপূর্বক কাজ করানো হতো। একপর্যায়ে আমার মনে হলো, আমরা সবাই পিশাচ হয়ে যাচ্ছি। আমি কেন এখনো এখানে আছি?

১৯৮২ সালের নভেম্বরে হিউ ওরেগন ছাড়েন। নতুন করে জীবন শুরু করার আগে প্রায় ৬মাস মানসিক চিকিৎসা নেন তিনি। হিউ বলেন, ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড কান্ট্রি ডকুমেন্টারিতে যা দেখানো হয়েছে তার অধিকাংশ ঘটনা তিনি ওরেগন ছাড়ার পর ঘটেছে।

তবে তিনি নিশ্চিত যে ওই সময় শীলা যেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছিলেন তা সম্পর্কে রাজনীশ জ্ঞাত ছিলেন। বিবিসি বাংলা।

এসআইএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।