বিধবা রোহিঙ্গা নারীর আর্তনাদ : ‘আমি তো এই সন্তান চাইনি’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:২০ পিএম, ০৩ জুন ২০১৮

পৃথিবীতে পদচিহ্ন আঁকার তিন মাস পেরিয়ে গেছে ছেলে শিশুটির। কিন্তু এখনো কোনো নাম রাখা হয়নি তার। মা উমা সুলেইমান; প্রত্যেকদিন রাতে বুকে জড়িয়ে আগলে রাখেন শিশুকে। সন্তানের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

তার অন্য সন্তানদেরও একইভাবে ভালোবাসেন, আগলে রাখেন এই মা। কিন্তু তিন মাসের ওই সন্তানকে যখন বুকে টেনে নেন তখন এক দুঃস্বপ্ন তাড়া করে তাকে।

গত বছরের দুঃসহ এক ক্ষতের ‘চিহ্ন’ নিষ্পাপ এই শিশু; ওই সময় মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে দেশটির সেনাবাহিনী উমা সুলেইমানদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় পাশের একটি ধানক্ষেতে। সেনাবাহিনীর পোশাক পরিহিত দু’জন তাকে পালাক্রমে ধর্ষণের পর রক্তস্নাত অবস্থায় সেখানেই ফেলে রেখে যায়।

মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর পরিকল্পিত অভিযানের সময় ধর্ষণের শিকার হাজার হাজার নারীদের একজন তিনি। আন্তর্জাতিক তদন্তকারীরা ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা রাখাইনে নিরাপত্তাবাহিনীর এই অভিযানকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছে। তবে নৃশংস অভিযানের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

rohingya-women

আরও পড়ুন : ধর্ষণে জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশুদের খোঁজে দৌড়ঝাঁপ

বাংলাদেশের জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরে ৯ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এই রোহিঙ্গারা নিজ বাড়ি-ঘরে আগুন, শিশুদের শিরশ্ছেদ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের গুলিতে প্রাণ হারানোর দুঃসহ ঘটনার স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেননি। এসব ঘটেছে তাদের চোখের সামনেই।

নিরাপত্তাবাহিনীর ধর্ষণ থেকে রেহাই না পাওয়ায় এখন কয়েক হাজার নারী ও তরুণী অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের মা হচ্ছেন। রোমহর্ষক স্মৃতি নিয়ে বাঁচার লড়াই করছেন তারা।

চিকিৎসকরা বলছেন, অনেক নারী ও তরুণী দাতা সংস্থাগুলোর ক্লিনিকে তাদের গর্ভাবস্থার অবসান ঘটাচ্ছেন। একেবারে সস্তা মূল্যের ওষুধ সেবন করছেন তারা। এর ফলে অনেকের স্বাস্থ্য জটিলতাও দেখা দিচ্ছে।

অত্যন্ত রক্ষণশীল রোহিঙ্গা সমাজে অনেক নারীই এখন পরিবার-পরিজনের চোখে কলঙ্কিত। পাশাপাশি শূন্য হাতে পরিবারের সদস্যরাও তাদের সেবা-যত্ন করতে অনীহা দেখাচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও সন্তানের জন্ম দিতে বাধ্য হচ্ছেন এই রোহিঙ্গা নারী ও তরুণীরা।

rohingya-women

আরও পড়ুন : সব রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে রাজি মিয়ানমার

সন্তান জন্ম দেয়ার সিদ্ধান্ত সবচেয়ে কঠিন একটি সিদ্ধান্ত ছিল উমা সুলেইমানের; কারণ তিনি বিধবা। কয়েক বছর আগে রোগাক্রান্ত স্বামী মারা যায় তার। রোহিঙ্গা এই নারীর বয়স মাত্র ৩০ হলেও রয়েছে পাঁচ সন্তান।

১৬ বছর বয়সে বড় মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পর কক্সবাজারের বালুখালি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে অন্য সন্তানদের লালন-পালন করছেন তিনি।

অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানের জন্ম দেয়ার ব্যাপারে উমা সুলেইমান বলেন, ‘আমি এই সন্তান চাইনি।’ তার নাম নিয়ে এখনো চিন্তা করছেন।

গত বছরের জুনে রাখাইনের মংডু জেলায় প্রায় হাফ ডজন সেনাসদস্যের ধর্ষণের শিকার হন ২৫ বছর বয়সী ফাতেমা। যখন তাদের বাড়িতে সেনাসদস্যরা হামলা চালায় তখন জীবন বাঁচাতে পাশের জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেন তার স্বামী মোহাম্মদ হুসেইন।

rohingya-women

আরও পড়ুন : সু চিকে আন্তর্জাতিক আদালতে তোলার আহ্বান শিরিন এবাদির

এ ঘটনার চার মাস পরে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয় ফাতেমার। এসময় হুসেইন দেখেন তার স্ত্রী গর্ভবতী। ফাতেমা বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে মনে হয়, আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। আমি ভেবেছিলাম, সে আমাকে তালাক দেবে।

কিন্তু তাদের প্রথম সন্তান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই বছর আগে মারা যায়। ফলে এই সন্তান সেই যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেবে বলে তারা চিন্তা করেন। মোহাম্মদ হুসেইন বলেন, ‘আমরা কখনোই গর্ভপাতের কথা মাথায় আনিনি। এ ধরনের ঘটনা অনেক নারীর সঙ্গেই ঘটেছে। আমরা মনে করি, আল্লাহ এই সন্তানের লালন-পালনের ব্যবস্থা করবেন।’

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নারী ও তরুণীদের ওপর দেশটির নিরাপত্তাবাহিনীর নৃশংস যৌন সহিংসতা দীর্ঘদিনের নিপীড়নের ভয়ঙ্কর আলামত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। নির্দিষ্ঠ ভূখণ্ডে আটকে রেখে দশকের পর দশক ধরে তাদের ওপর এই নিপীড়ন চলে আসছে।

আরও পড়ুন : ৮০টি প্লাস্টিক ব্যাগ খেয়ে মারা গেল তিমি

আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা মেডিসিনস স্যানস ফ্রন্টিয়ারসের (এমএসএফ) মার্সেল্লা ক্রেয়ায় বলেছেন, শরণার্থী শিবিরে চলতি বছরে প্রায় ৪৮ হাজার সন্তান জন্ম দেবেন। যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল তারা শিগগিরই সন্তানের মা হবেন। তবে এদের অধিকাংশই মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে গোপনে অথবা বাঁশের খুপরি ঘরে কোনো ধরনের মেডিক্যাল সহায়তা ছাড়াই কঠিন এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন।

লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইনে শুরু হওয়া দেশটির সেনাবাহিনীর কঠোর অভিযানে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছেন। এদের অধিকাংশই শিশু ও নারী।

আন্তর্জাতিক দাতব্যসংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাখাইনে কমপক্ষে ৯ হাজার ৪০০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে শুধুমাত্র সহিংসতার কারণে প্রাণ গেছে ৬ হাজার ৭০০ জনের (নিহতদের ৭১.৭ ভাগ)। নিহতদের মধ্যে ৭৩০ শিশু রয়েছে; যাদের বয়স পাঁচ বছরের নিচে।

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানকে জাতিগত নিধনে ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে মন্তব্য করেছে জাতিসংঘ। তবে অভিযানের শুরু থেকেই এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে দেশটি।

সূত্র : লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস।

এসআইএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।