জাপানি টাকা


প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ০১ আগস্ট ২০১৫

পুরো নাম মনে নেই, টাকাকিশু না এরকম কিছু। পরিচয়ের প্রথমেই বলেছিল, ‘মাই নেম ইজ টাকা।’
বলেছিল, ‘পুরো নাম বলছি, কিন্তু জানি তুমি মনে রাখতে পারবে না। এর চেয়ে টাকাই ভাল। তোমার মনে থাকবে।’
‘নিশ্চয়ই থাকবে। আমার দেশের কারেন্সি কি জানত?’ বললাম আমি।
‘টাকা। আমি জানি। আমি ঢাকায় ছিলাম বেশ ক’বছর।’

টাকা জাপানিজ ডিপলোম্যাট। কাঠমান্ডুতে আসার আগে ওর পোস্টিং ছিল ঢাকায়। ছয় বছর ছিল। পেশাদার কূটনীতিকের মত বলল, ‘সুন্দর দেশ।’

কাঠমান্ডুতে আমাদের বেশ ভাল একটা গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেল। আমি, টাকা আর সুশান্থা। সুশান্থা হচ্ছে শ্রীলঙ্কান ডিপলোম্যাট। কাল মুখে লাবণ্য খেলা করে। আর শ্রীলঙ্কান স্টাইলে শাড়ি যখন পরে, তখন ওকে আমার কেন জানি সীতার মত মনে হয়। রাবনের বন্দীখানায় সীতা যখন বন্দী ছিলেন, এরকম শাড়ি পরতে শিখেছিলেন কি? আমার মনে হয়, শিখেছিলেন। এত নান্দনিক স্টাইল, সীতা মনে হয় শিখে নিয়েছিলেন। সীতাকে লংকানারীর মত শাড়ি পরতে দেখেই কি রাম সন্দেহের ধাঁধায় পড়েছিলেন, যাতে সীতাকে প্রস্তুত হতে হয় নিদারুণ অগ্নিপরীক্ষায়?
সুশান্থা বাঙ্গালি স্টাইলের শাড়ি পরা শিখেছিল।

এক বিকেলে এরকম ‘বাঙালি’ সুশান্থকে দেখে টাকা কেমন যেন অস্থির হয়ে গেল। আমরা সেদিন থামেলে সার্ক হেডকোয়ার্টারের পার্কিং-এ গাড়ি রেখে রাস্তায় হাঁটছিলাম। টাকা এরকম হাঁটাহাঁটিতে অন্য দিন খুব উৎসাহ দেখায়, অবিরাম বকবক করে। আজ চুপ হয়ে গেল। ফিরে যেতে চাইল। শরীর ভাল নেই হয়তো, আমি ভেবেছিলাম সেরকমই।

সুশান্থা টাকার কোমর জড়িয়ে ধরে ওর উদ্বেগ প্রকাশ করে। আমার স্বভাবজাত রক্ষণশীল চোখে এই জড়িয়ে ধরার অর্থ একটু অন্য রকম মনে হলেও প্রকাশের প্রয়োজন মনে করিনি। শাড়ির উপরে নিজে কখনো উঠতে পারিনি, ওদিকে সুশান্থা আধুনিকা, পোষাকে তো বটেই, চলনে বলনেও। এই যে শাড়ি পরেছিল বাঙালি স্টাইলে, তার মধ্যেও যে আধুনিকতার প্রকাশ দেখেছি, তা থামেলের নেওয়ারি স্থাপত্যকে হার মানিয়ে দিতে যথেষ্ট। ওর আচরণের সব অর্থ আমি ধরতে পারব, এমনটা ভাবছি কেন? অগত্যা ভাবাভাবি বাদ দিয়ে টাকাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব করি।
টাকার ডিপলোম্যাটিক গাড়িতে করেই সেদিন আমরা ঘুরতে বের হয়েছিলাম। কখনো কখনো সুশান্থার সরকারি গাড়িটাও থাকে। আমি বেচারি সে দিক দিয়ে নিতান্তই দরিদ্র। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করছি, তবে সুবিধার সীমারেখা খুব একটা প্রশস্ত নয়। সরকারি গাড়ির ফুরসত নেই আমার মত অত্যন্ত পাতি ডিপলোম্যাটের সঙ্গ দেওয়ার। ত্রিভুবন বিমানবন্দর, কাঠমান্ডুর হোটেলসমূহ আর দর্শনীয় স্থানগুলোতে ভিআইপি, ভিভিআইপিদের ভ্রমণ ও আসা-যাওয়ার সুবন্দোবস্ত করতে একটি মাত্র গাড়ি আর কিভাবে ফুরসত খুঁজে নেবে? তাই বলে আমার অভিযান কি ঘরের ভেতর বসে হাই তুলবে? সেরকম হয়নি। নেপালিদের মত পায়ে হাঁটার চমৎকার অভ্যেস দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। টাকা আর সুশান্থা মুখে কিছু না বললেও ঘুরে বেড়ানোর যে কোনো প্রোগ্রামে আমার গাড়ির কথা কখনোই তোলে না, নিজেরা হাজির হয়ে যায় শকেটসমেত।

টাকার বাড়িতে এর আগে আসা হয়নি। সুন্দর ছিমছাম বাংলো, একজন মানুষের থাকার জন্য যথেষ্ট বড়। টাকা একাই থাকে, বউ-টউ আছে কি না জানতে চেয়ে যেরকম উত্তর পেয়েছি, তাতে মনে হয়েছে, টাকা এখনো ব্যাচেলর। জাপানিদের বয়স বোঝা মুশকিল, তবে আন্দাজ করে নিতে পারি টাকা খুব একটা কচি খোকা নয়। ভারত-বাংলাদেশ হয়ে নেপালে পোস্টিং করতে এসেছে, গড়ে তিন বছরের সময়কাল হিসেব করলেও আগে পিছের সময় মিলিয়ে বার-তের বছরের চাকরি জীবন তো হবেই। টাকা পঁয়ত্রিশের কম নয় নিশ্চয়ই। প্রশ্ন করেছিলাম একদিন, ‘হাউ ওল্ড আর য়্যু?’

টাকা দুষ্টু হাসি হেসে পাল্টা মনে করিয়ে দেয়, ‘তোমাদের দেশে কারোর বয়স জানতে চাওয়া অভদ্রতা মনে করা হয়।’
‘আরে না! মেয়েদের বয়স জানতে নেই, এরকম কথা অনেকে বলে বটে, তবে আধুনিক মেয়েরা ওসব মানে না কি? নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বাপু তোমাদের চেয়েও অনেক এগিয়েছে। ক্ষমতায়িত নারীরা বয়স বিশ পেরুল কি বুড়ি হয়ে গেল কি না এই ভয়ে অস্থির নয়। বয়স এখন বোঝা নয়, লজ্জার বিষয়ও নয়, বুঝেছ?’
‘হাউ ওল্ড আর য়্যু, ডিয়ার?’

টাকা দুষ্টু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেই প্রশ্ন করে আমাকে এবং সুশান্থাকেও। আমি সোজা সাপ্টা বলে দিতে চাইছিলাম, আমার বয়স কত। টাকাকে দেখিয়ে দিতে চাইছিলাম, বয়স নিয়ে কোনো দ্বিধা আজকালের মেয়েদের মত আমারও নেই। তবে সুশান্থার প্রতিক্রিয়া আমাকে থমকে দিল। সুশান্থা রেগে গেল খুব। টাকাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘এই ধরনের প্রশ্ন সে আর কোনো দিন শুনতে চায় না।’ কেন শুনতে চায় না, তার জবাব দিতেও সে আগ্রহী নয়। সুশান্থা এই বিষয়ে পরে বলেছিল আমাকে, সুশান্থা আর আমি যখন এক সাথে শপিং করতে বের হয়েছিলাম। মেয়েলি শপিং বলেই টাকাকে ক্ষুণাক্ষরেও টের পেতে দেওয়া হয়নি এই প্রোগ্রামের কথা। আমি জানি, টাকাকে সাথে আনলেও খুব একটা সমস্যা হ’ত না। ও সত্যিকারের সাহায্যকারীর মতই সাহায্য করার চেষ্টা করত।

সুশান্থার মা-দাদী-নানীদের বক্তব্য, মেয়েদের বয়স জানতে চায় কেবল অশুভ শক্তিরা। বয়স জেনে নিয়ে অশুভ শক্তি দিয়ে সেইটুকু সমান আগাম বয়স চুরি করে নিয়ে যায়, ফলে অকালে মরতে হয় যার বয়স তার। শিক্ষিতা সুশান্থা কোনো কুসংস্কারে বিশ্বাস না করলেও নিজের বয়স আর জীবন নিয়ে কোনো  চান্স নিতে রাজি নয়। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘টাকা কি অশুভ শক্তি নাকি? ও তো বেশ ভাল ছেলে।’
‘নো চান্স, দেওয়ার ইজ ওলওয়েজ আ ‘ইফ’!’

যদির ফাঁদে পড়বে না সুশান্থা। যদিও টাকার প্রতি ওর আবেগ আছে, সে আবেগ প্রকাশেও সরল-সহজ সৌন্দর্য আছে যা আমাকে মুগ্ধ করে দেয়। এর পরও ‘ইফ’! সুশান্থা বাঁচতে ভালবাসে, নিজেকে ভালবাসে, তাই ‘ইফ’ নিয়ে সতর্ক থাকে। এক মুহূর্তের অসচেতনতা ওর বেঁচে থাকার আনন্দকে ম্লান করে দেয় যদি, এই যদিও সাবধানতা সুশান্থার আছে। এই বিষয়টিও মুগ্ধ করেছিল আমাকে।

টাকার বাড়ির সদর দরজা থেকে বৈঠকখানা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভুলে গেলাম, কেন এখানে এসেছি, টাকার অসুস্থতা কিংবা আর কোনো কিছু। আমি থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছি, উদভ্রান্তের মত ঘুরছি আর কি ভাবছি বা ভাবছি না তার কিছুই বুঝতে পারছি না। এর কারণ, শাহাবুদ্দিন। শিল্পী শাহাবুদ্দিন। বাংলাদেশের শিল্পী শাহাবুদ্দিন, যিনি কি না সমসাময়িক বিশ্বের সেরা শিল্পীদের নেতৃস্থানীয়, যিনি দীর্ঘ প্রবাস জীবনেও তুলিটাকে বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধে আকণ্ঠ চুবিয়ে রাখতে পেরেছেন, সেই শিল্পীর অসংখ্য স্কেচ আর পেইন্টিং এই জাপানি টাকার বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে বাংলাদেশকেই তুলে এনেছে। বাজি ধরে বলতে পারি, এই ছবিগুলো খুব বেশি প্রদর্শিত হয়নি, আনকোরা নতুন ঠেকল চোখে আর প্রকাশের সারল্য এমনই যে আমি সত্যিই ঘোরে পড়ে গেলাম। টাকা আমার অবস্থা দেখে ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, আমি বাংলাদেশে ছিলাম, সে তো জানই। তখনি এই সংগ্রহগুলো গড়ে তুলেছি।

টাকা আমার সাথে সাথে ছবিগুলোর সামনে দাঁড়াল। প্রতিটা ছবির রং-আলো-ভাব ওকে টলিয়ে দিচ্ছিল গভীর ভাবে। আমি নিজেও আবিষ্ট হচ্ছি, জাপানি টাকা আমার শাহাবুদ্দিনকে ভালবাসে, এ গৌরবে আমার গ্রীবা উন্নত হচ্ছে। সুশান্থা এসবে ছিল না। লংকান নারী বাঙালি শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজতে শেখেনি, ওভাবে ছড়িয়ে রেখেই টাকার ডাইনিং টেবিল সাজাচ্ছে। টাকার নেপালি কর্মচারী সুশান্থাকে সাহায্য করছে। ছবি দেখা শেষ হলে সুশান্থাকে ওভাবে দেখে আমি বলে ফেললাম, ‘বাহ্! সুশান্থা তো এ বাড়িকেই নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে!’

সুশান্থার জায়গায় বাঙালি মেয়ে হলে গলা চিপে ধরত। সুশান্থা কিন্তু সরল মুখে জবাব দিল, ‘আমার কাছে আমার আমার বলে কিছু নেই। যখন যেখানে, সেটাই তখন আমার। আজ বেঁচে আছি, কাল থাকব না। আজ যা হাতের কাছে পাচ্ছি, তা-ই আমার। কাল এ নিয়ে দাবি তুলব না।’ শ্রীলংকান দার্শনিক আনন্দ কুমারাস্বাওয়ামির এই দর্শন সুশান্থার ভাল লাগে। বুঝতে পারলাম, এই দর্শনের বলেই টাকার ডাইনিং টেবিল সুশান্থা নিজের করে নিয়েছে। আমি সাজানো টেবিলটার দিকে এগুতে চাই, তখন টাকা আমার হাত চেপে ধরে বলে, ‘তোমার সাথে আমার কথা আছে।’
টাকা তখন একদম অন্য রকম। হাসিখুশি শান্ত ভাবটা উধাও। টাকা তখন খুব অস্থির। আমি বুঝতে পারি না। বলি, ‘বল।’

‘এখন নয়। আই উইল কল য়্যু। প্লিজ, রিসিভ মাই কল।’
আমি ধাঁধায় ঘুরপাক খেয়ে বলি, ‘আই উইল।’

টাকা আমার বন্ধু, আই উইল রিসিভ হিজ কল। কিন্তু, টাকা কি বলতে চায়, এ নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলাম। টাকার চোখে অন্য রকম আলো দেখেছি, তাতে সহজ ভাবের ছাপ নেই। আমি যা ভেবেছিলাম, তা-ই। টাকার ফোন পেয়ে থামেলের জাপানিজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করতে গেলাম। ভেবেছিলাম, সুশান্থাও থাকবে। টাকা জানাল, আজকের লাঞ্চের দাওয়াত কেবল আমারই।
‘কেন?’

‘তোমার সাথে আমার কথা আছে। আসলে আমি যা বলব, তা কেবল তোমাকে জানানোর জন্যই।’
টাকা এমনিতে মৃদুভাষী, এখন যেন আরো মৃদু হয়ে গেছে। খুব আনমনা স্বরে কথা বলছে, আমি কান খাড়া করে শুনছি। শুনতে শুনতে এক সময় টের পাই, আমার ভেতরে রাগের আগ্নেয়গিরি ফুঁসছে। আমি বিস্ফোরনণ ফেটে পড়ব হয়তো বা, ডিপলোম্যাটিক ভদ্রতার মুখোশ জোর কেরে টেনে ধরি মুখের উপর। এত সহজে ধৈর্য্য হারালে চলবে কেন?

টাকা বলছিল ওর ঢাকাবাসের সময়কালের কথা। না না, তারও আগে, ও যখন কোলকাতায় পোস্টিং করছিল, সে সময়কার কথা। শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশের এক মেয়ে পড়তে গিয়েছিল। তার সাথে খুব ভাব হয়েছিল টাকার। সেই ভাবের টানেই কোলকাতার পরের পোস্টিং হিসেবে ঢাকাকে বেছে নিতে এক মুহূর্তও ভাবতে হয়নি। টাকা গিয়েছিল ঢাকা। বিয়ে করেছিল। হ্যাঁ, বিয়ে করেছিল সেই মেয়েটিকেই। অসম্ভব সাংস্কৃতিক মনের অধিকারী সেই শ্যামলা মেয়েটি আর বাংলাদেশের বৃষ্টি টাকার জীবনটাকে ভরিয়ে তুলেছিল। সাথে যোগ হয়েছিল শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ছবিগুলো। যখনি সুযোগ পেয়েছে, শিল্পী ঢাকায় এসেছে খবর পেলেই টাকা ছুটে গেছে, সংগ্রহ করেছে শিল্পীর আঁকা ছবি। এভাবেই কেটে গেছে টানা ছয় বছর।
‘তারপর?’

তারপর এসেছিল ফিরে যাওয়ার ডাক। জাপানে ফিরে যেতে হবে টাকাকে। ফিরে গেল টাকা, গেল একা। সেই মেয়েটি রয়ে গেল ঢাকাতেই। ততদিনে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে দুজনের।
‘কেন?’

টাকা সহজ ভঙ্গিতে বলে, ‘ইট ওয়াজ ওকে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনেক জানা হয়ে গিয়েছিল।’
বাংলাদেশের মেয়েটি সম্বন্ধেও অনেক জেনে ফেলেছিল বুঝি? একঘেঁয়ে লাগছিল? টাকা সেরকম কিছুই বোঝাতে চাইল। সম্পর্কটা আর ওর কাছে প্রয়োজনীয় ছিল না। যে সম্পর্ক অপ্রয়োজনীয়, তা টেনে নিতে বাধ্য নয় ও। টাকার চোখ-মুখের রুক্ষতা আমাকে মনে করিয়ে দেয়, জাপানী স্বামীরা পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে স্বামী। ওদের মত বউ পেটাতে আর কেউ পারে না।

টাকার নেপালি জীবন মধুর করে তুলতে সুশান্থা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। ও সুশান্থাকে বিয়ে করতে চায়। আমার কাছে অনুরোধ, আমি যেন সুশান্থাকে শাড়ি পরিয়ে বাঙালি করে না তুলি। টাকা পেশাদার ডিপলোম্যাট। লংকান নারী সুশান্থার বাঙালি সাজ ওকে আগ্রহী করে তোলে না।

আমি খোঁচা মেরে বলি, ‘নাকি, তুমি অস্বস্তিতে পড়ে যাও? হয়তো স্বীকার করতে চাইছ না, কিন্তু হয়তো শাড়ি পরা সুশান্থাকে দেখে বাংলাদেশের সেই মেয়েটির কথা তোমার মনে পড়ে যায়!’

না, টাকার নাকি কোন অস্বস্তি নেই। সে এখনো বাংলাদেশে থাকা তার এক্স-ওয়াইফকে বন্ধু মনে করে। তবে জীবনের প্রয়োজনে এখন তার সুশান্থাকে চাই। নেপাল ছেড়ে যাওয়ার সময় সুশান্থাও অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠবে না তো? এই প্রশ্নটি করে ফেলতে চেয়েছিলাম, নিজের কাছেই কেমন বাঁধল বলে আর করা হ’ল না। সময়-সুযোগ পেলে আরেক দিন জেনে নিতে হবে প্রশ্নের উত্তরটা। আপাততঃ শুকনো বৈশ্বিক ভদ্রতার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে টাকাকে শুভেচ্ছা জানাই। ওর আগামী জীবন সুন্দর হোক্, এই কামনা করছি বলে জানাই। যদিও মনে মনে টাকার প্রতি আগের মত বন্ধুভাবাপন্ন অনুভূতি টের পাচ্ছি না। আমার দেশের এক তরুণীর হৃদয় ভেঙ্গেছ তুমি, তোমাকে দরদ দেখাতে বয়ে গেছে আমার!

সত্যিই কিন্তু, এর পরে আমাদের তিনজনের আড্ডা জমতে চাইল না। টাকা আর সুশান্থা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাইছে, একই সাথে আমিও চাইছি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ওদেরকে এড়িয়ে যেতে। সুশান্থার সাথে আমার কোনো সমস্যা নেই, হাসি-খুশি মেয়েটিকে আমি পছন্দ করি। অনেক আলাপ আছে কেবল  সুশান্থার সাথে করা যায়, অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। থাই এ্যামবাসাডরের স্পাউস কেন একজন পুরুষ, এ আলাপ সুশান্থার সাথে না করলে জমে না। আমেরিকান এমব্যাসিতে যে কোনো মিটিং-এ গেলেই সিকিউরিটি চেকের নামে যে রকম বাড়াবাড়ি করে, তা নিয়ে আমরা তিন জন ফিসফিস করে বলি, হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেলে যে শব্দ হবে, তাতেই বুঝি এই আমেরিকানদের হার্টফেইল হয়ে যাবে।  কিন্তু আমেরিকান এ্যমবাসডরের পিএ সংক্ষিপ্ত স্কার্টের সাথে হাই হিল পরে নিজেকে প্যারিস হিলটন না এমা ওয়াটসন ভাবছে, তা নিয়ে গভীর আলোচনা কেবল সুশান্থার সাথেই হবে, টাকা তখন অপাঙতেয়। ডিপলোম্যাটিক পার্টিতে আমাদের দেখা হলে এখনো আমরা তিন জনই ঘন হয়ে বসি, কিন্তু আগের মত অনানুষ্ঠানিক আড্ডাবাজি বড্ড কমে গেছে আমাদের।

টাকার বাংলাদেশি বউয়ের ব্যাপারে সুশান্থার নিষ্পৃহতা আমাকে অবাক করেনি। আধুনিকা মেয়ে, অতীত নিয়ে খোঁচাখুচি করে বর্তমানকে জলাঞ্জলি দেবে কেন ও? সুশান্থার আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা দেখে আমি মুগ্ধ। এই যে টাকার সাথে ওর প্রেম, যেহেতু বিয়ে হয়নি মেয়েটার, ধরে নেওয়া যায় এ প্রেম বিবাহপূর্ব আবেগি প্রেম, প্রথম প্রেম না হলেও কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়। কিন্তু কোথাও আবেগের কোনো বাহুল্য নেই, গদগদ ভাব নেই। আমার সামনে প্রেমের বাহ্যিক প্রকাশ ঘটাতে সুশান্থা আগ্রহী নয়। কয়েক বার টাকা সেরকম চেষ্টা করতে গিয়ে সুশান্থার অমনোযোগী মনোভাবের কারণে দমে গেছে। আমি মনে মনে হেসেছি টাকার হ্যাংলাপনা দেখে। এই রকম ঢং বাংলাদেশি মেয়েটার সাথেও করেছে নিশ্চয়ই। আমাদের মেয়েগুলো তো সহজেই ভুলে যায়, গলে যায়। লংকান নারীর হৃদয় অত সহজে গলাতে পারছে না টাকা। সহজে হাতে ধরা দিতে চাইছে না মনে হয়।

ঝামেলা কেবল সুশান্থা নয়, সুশান্থার পরিবার, দেশ এমনকি সরকারও বাঁধিয়ে দিল। এক দিন টাকার ব্যাকুল কণ্ঠের ফোন পেলাম। ওর কাছ থেকেই শুনলাম, সুশান্থা জাপানি কূটনীতিক টাকাকে বিয়ে করার জন্য অনুমতি চেয়েছিল। পরিবার না করে দিয়েছে। এরপরও সুশান্থা টাকাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কূটনৈতিক সার্ভিসের শর্ত মেনে লিখিত আবেদন করেছিল লংকান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সোজা না বিষয়ক জবাব এসেছে।
‘তাহলে আর কি? বিয়েটা গেল, না কি?’

আমার কৌতুক বোঝে না টাকা। ও বলল, এ নিয়ে যুদ্ধ করবে ওরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে রাজি করানোর জন্য ওর কিছু তথ্য দরকার, আর সেসব কেবল আমি-ই দিতে পারি। বাংলাদেশি কূটনীতিক ইসমত জাহান বিদেশিকে বিয়ে করেছে, আর তার জন্য বাংলাদেশের চাকুরিবিধিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে, এই কথা জানিয়ে টাকা আবদার করে, ঐ বিয়ের খুঁটিনাটি তথ্য আর চাকুরিবিধির ধারা পরিবর্তনের সবকিছু ওকে ডকুমেন্টসমেত সাপ্লাই দিতে হবে। এসব ফরোয়ার্ড করা হবে লংকান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ইসমত জাহানের উসিলায় ওদের হিল্লে হলেও হতে পারে। এর মানে কি? ইসমত জাহান বাংলাদেশি। টাকা ওর স্বার্থ উদ্ধারে বাংলাদেশি ছাড়া আর কাউকে কি খুঁজে পায় না?

টাকার অনুনয়-আবদারে আমার কোনো গরজ নেই, আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ পৌঁছে গেছে অন্য মোকামে। আমি টাকার বাড়ি থেকে শাহাবুদ্দিনের সবকিছু উদ্ধার করতে চাই। কেন চাইব না? ব্যাটা জাপানি আমার দেশের একটি মেয়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বাংলাদেশি শিল্পীর শিল্প নিয়ে নিজের উন্নত রুচির প্রমাণ দেখানোর কোনো অধিকার আছে ওর?

টাকার আবদার এ কান থেকে ও কান করি আর বারবার আমি জানতে চাই, ‘সুশান্থার সাথে বিয়ের পর তোমার বাড়িতে কি তবে শাহাবুদ্দিন থাকতে পারবেন? সুশান্থা কিভাবে নেবে ব্যাপারটা?’

টাকা বলল, ‘কিচ্ছু হবে না। উনি কি বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত নাকি? উনি এখন প্যারিসে থাকেন। উনি এখন সারা বিশ্বের সম্পদ। সুশান্থার কোন সমস্যা হবে না।’

‘কে বলেছে?’ প্রতিবাদে ফেটে পড়ি আমি। শিল্পী শাহাবুদ্দিন একজন মুক্তিযোদ্ধা, উনি মনে প্রাণে খাঁটি বাংলাদেশি। টাকাকে ভয় দেখিয়ে বলি, ‘তুমি উনাকে সুশান্থার ভয়ে নন-বাংলাদেশি বানাতে চাইছ, এ যদি উনি জানতে পারেন, তবে দেখ তোমার কি হাল হয়! আর শোন, সুশান্থা কিন্তু একটা মেয়ে। মেয়েরা ভয়ানক ঈর্ষাকাতর হয়। তুমি তোমার এক্স-ওয়াইফের স্মৃতিস্বরূপ শিল্পী শাহাবুদ্দিনের শিল্পকর্মগুলোকে সযতনে সাজিয়ে রাখছ, সুশান্থার ভাল লাগবে না ব্যাপারটা। এক দিন না এক দিন এ নিয়ে গ্যাঞ্জাম হবেই।’

টাকার সরু চোখ দিন কে দিন আরো সরু হয়ে যাচ্ছে। আমার প্রতি ওর বিদ্বেষ জমে যাচ্ছে ভাল ভাবেই। আমিও পাওনাদারদের মত গলা তুলছি। ছবিগুলো আমার চাই, ভালয় ভালয় দিয়ে দাও বলছি টাইপের কথাবার্তা শুরু করেছি। এর ফলে টাকা দিনকে দিন শীতল হতে শুরু করল। আমার কাছে ওর আর কোনো কাজ নেই, আমাকে এড়িয়ে চলাটাই বরং ওর কাজ হয়ে দাঁড়াল। আমাকে অগত্যা সুশান্থার সাথেই বকবক করতে হয়। কিছু দিনের মধ্যেই টের পেলাম, সুশান্থার মাঝে টাকার শীতলতা ছড়িয়ে পড়ছে। স্পষ্ট জানতে চাইলাম,‘সুশান্থা! সামথিং রং! য়্যু আর ট্রাইং টু এভয়েড মি। টাকা তোমাকে বলেছে, আমাকে এড়িয়ে চলতে বলেছে, তাই না সুশান্থা?’

সুশান্থা সোজাসাপ্টা মেয়ে। বলেই ফেলল, আমি নাকি বিপদজনক মানুষ। আমাকে এড়িয়ে চলাই ভাল। টাকা ওকে বলেছে, আমি আসলে বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি সংগ্রহ করি, তারপর বিরাট ডিলারদের হাতে তুলে দেই। আমি নাকি আন্তর্জাতিক কোন্ গ্যাঙের সাথে সম্পর্ক রেখেছি। আমার কোটি কোটি ডলার ইনকাম হয় চোরাই পেইন্টিং বিক্রি করে।

আমি হাসি হা হা করে। বলি, ‘পুলিশকে জানাচ্ছ না কেন?’

সুশান্থা টাকার ভাষ্য আমাকে শুনিয়ে দেয়। আমি যদি বেশি বাড়াবাড়ি করি, তাহলে নেপালের পুলিশকে অবশ্যই জানানো হবে সব। অগত্যা আমাকে ভাল হয়ে যেতে হবে। টাকার বাড়ির দেয়ালে ঝুলানো ছবিগুলোর কথা ভুলে যেতে হবে। আমি আর কিছুই বলতে চাইনি, বললামও না। ওদের কারোর সাথেই আমি আর যোগাযোগ রাখতে চাইনি, রাখলামও না। তবে টের পেলাম, টাকা আর সুশান্থা বিয়ে করেনি। বিয়ে করলে কোনো না কোনোভাবে খবরটা পেয়ে যেতাম। লংকান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাকি হ্যাঁবোধক জবাবও পাঠিয়ে ছিল, তবুও বিয়েটা হয়নি। ওরা এক সাথে টাকার বাড়িতেই থেকেছে। টাকা আর সুশান্থা বিয়ে না করেই এক সাথে থাকছে, এ খবরটা গরম ছিল কাঠমান্ডুর ডিপলোম্যাটিক হাওয়ায়।

বছর দেড়েক পর টাকা এসেছিল আমার বাড়িতে। নেপাল ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বদলির আদেশ এসেছে। সুশান্থা নেপালেই থাকছে। টাকা আশা করে, সুশান্থা নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারবে। আমারও মনে হয়, সুশান্থা পারবে। ও অনেক শক্ত মেয়ে।

আমি জানতে চাই, ‘ছবিগুলো কি করবে? দেবে আমাকে?’ আমি হাসি। বলি, ‘আমি হচ্ছি আন্তর্জাতিক আর্ট ডিলারদের দলের একজন। ছবিগুলো পেলে কোটি কোটি ডলার আয় করতে আমার বড্ড সুবিধে হ’ত।’
টাকা আমার দুই হাত চেপে ধরে। টাকার শরীরের কম্পন আমি টের পাই। ওর সাদা হয়ে যাওয়া শুকনো মুখ দেখি। টাকা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি জান না, তোমাকে বোঝাতে পারব না, ছবিগুলো একটি একটি করে যখন সংগ্রহ করেছি...আমরা দু’জন প্রবল বৃষ্টিপাতের ভেতর চলে গেছি শাহাবুদ্দিনের স্টুডিওতে, কখনো কখনো একজিবিশনে... তার খোঁপায় সুগন্ধি ফুলের মালা আমি নিজের হাতে পরিয়ে দিয়েছি...প্রতিটি ছবির ব্যাখ্যা আমি জেনেছি তার কাছ থেকে, তোমার দেশের প্রকৃতি আর মানুষের সৌন্দর্য চিনতে শিখিয়েছে সে... ছবিগুলো আমার কাছে থাকতেই হবে।’

আমি কোমল স্বরে প্রশ্ন করি, ‘ছবিগুলোর জন্য এত মায়া, সেই মেয়েটির জন্য মায়া নেই বুঝি?’
টাকা দীর্ঘশ্বাসে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যায়। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলে না। বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে, ‘সন্তান চেয়েছিল খুব।’

টাকা চলে যাওয়ার পর সুশান্থার সাথে আবারো দেখা হলে গল্প করা শুরু হয়। সুশান্থা টাকাকে নিয়ে কোনো কথা বলে না। টাকার প্রসঙ্গ আসলেই ওর চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। একদিন না পেরে বলল, ‘টাকা যেখানে যায়, সেখানেই প্রেমিকা নয়তো বউ জুটিয়ে বসে।’ হবে হয়তো। আমি মনে মনে সমাধান টানি। টাকার বাংলাদেশি বউটা যখন জেনে ফেলল টাকার এরকম কীর্তি কাহিনীর কথা, তখনি নিশ্চয়ই বিচ্ছেদ নিয়ে নেয়। কিন্তু, টাকা যে বলল, সেই মেয়েটি সন্তান চেয়েছিল খুব। আমার ভাবনায় নতুন আলো খেলে। টাকা হয়তো বা সন্তান দিতে পারেনি। অবিশ্বস্ত স্বামীর সাথে সংসার কিংবা সন্তান দিতে অক্ষম স্বামীর সাথে সংসার করাটা কষ্টকর নয় তো কি? সুশান্থাও কষ্টটা করেনি। লংকান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নো অবজেকশন পেয়েও বিয়েটা করেনি।

তবে আর টাকার থাকল কি? ও যেখানেই যাবে, সেখানকার বাড়ির দেয়ালে ঝুলবে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের অসাধারণ শিল্পকর্মগুলি। টাকা যতখানি চরিত্রহীনতার ছাপ নিয়ে বাস করছিল, কেন যেন আমার কাছে টাকার সে রূপটা রইল না। আমার চোখে ভাসে টাকার সাদা হয়ে যাওয়া শুকনো মুখ, কানে ভাসে টাকার কণ্ঠ, ‘... ছবিগুলো আমার কাছে থাকতেই হবে।’

এইচআর/এমআরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।