সিদ্ধান্ত মালয়েশিয়ার জনগণের

আহমাদুল কবির
আহমাদুল কবির আহমাদুল কবির , মালয়েশিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০:৫২ পিএম, ০৮ মে ২০১৮

৯ মে, বুধবার মালয়েশিয়ার জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে দেশটির সাধারণ জনগণ দুই জোটের হয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন। মঙ্গলবার দেশটির স্থানীয় সময় রাত ১২টায় শেষ হয়েছে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক গত ৬ এপ্রিল পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এবারের নির্বাচনটি ক্ষমতাসীন জোটের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হতে চলেছে বলে মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ, বেশ চাপের মুখেই আছেন ৬৪ বছর বয়সী নাজিব।

স্টেট ফান্ড অর্থ-কেলেঙ্কারি এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে নিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নন মালয়েশিয়ার সাধারণ জনগণ। এদিকে বিরোধী দল থেকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন পেয়েছেন নাজিবের সাবেক গুরু, আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদ। এখন সিদ্ধান্ত মালয়েশিয়ার জনগণের, তারা কাকে বেছে নেবেন তাদের শাসক হিসেবে।

যদিও এবারের নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরকেই এগিয়ে রাখছেন বিশ্লেষকরা। দেশটির নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান মারদেকা সেন্টার জানায়, জনপ্রিয়তার ভোট জরিপে ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ পেয়েছে মাহাথিরের পাকাতান হারাপান জোট। ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটে দ্বিতীয় স্থানে নাজিবের বারিসান ন্যাশনাল।

টানা ২২ বছর শাসনের পর ২০০৩ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান মাহাথির মোহাম্মদ। লম্বা বিরতি দিয়ে ৯২ বছর বয়সে আবারও নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। দায়িত্ব নিয়েছেন তার সময়ে বরখাস্ত হওয়া উপ-প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের জোট পাকাতান হারাপানের।

m

মাহাথির মোহাম্মদ যদি নির্বাচনে অংশ না নিতেন, তাহলে এ নির্বাচন একপেশে হতো বলে অনেকের ধারণা। তার সাবেক দল ইউনাইটেড মালয়স ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনকে এ নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন মাহাথির মোহাম্মদ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের কর্মকাণ্ডে হতাশ হয়ে ২০০৩ সালে এ দল থেকে পদত্যাগ করেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। সেখান থেকে পদত্যাগের পর মাহাথির মোহাম্মদ নিজেই একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। সে দল সরকারবিরোধী জোটে যোগ দেয়।

মালয়েশিয়ার সরকারবিরোধী জোট প্রধানমন্ত্রী পদে লড়াইয়ের জন্য মাহাথির মোহম্মদকে নির্ধারণ করেছে। সরকারবিরোধী এ জোটের নেতা ছিলেন আনোয়ার ইব্রাহিম। মাহাথির মোহাম্মদ ক্ষমতায় থাকার সময় আনোয়ার ইব্রাহিম ছিলেন তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি।

১৯৯৯ সালে আনোয়ার ইব্রাহিমকে সমকামিতার অভিযোগে কারাগারে পাঠান মাহাথির মোহাম্মদ। ২০০৩ সালে মাহাথির মোহাম্মদের বিদায়ের পর ২০০৪ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পান ইব্রাহিম। ২০১৩ সালের নির্বাচনে বর্তমান ক্ষমতাসীন নাজিব রাজাকের দলের বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি।

সে নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের দল অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরেছিল এবং নাজিব রাজাকে মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। এরপর ২০১৫ সালে সেই সমকামিতার অভিযোগে আনোয়ার ইব্রাহিমকে আবারো জেলে পাঠানো হয়। এখন আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরোধী জোট থেকেই নির্বাচন করছেন মাহাথির মোহাম্মদ। নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারলে কিছুদিন পর আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে এমনটাই পরিকল্পনা রয়েছে বিরোধী জোটের।

s

মাহাথির মোহাম্মদ মনে করেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাককে ক্ষমতা থেকে সরানোই হচ্ছে আসল উদ্দেশ্য। এ দিকে নির্বাচনী এক ভাষণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক অভিযোগ করেন, বিরোধী জোটের অন্তর্ভুক্ত ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টি ড. মাহাথির মোহাম্মদকে ব্যবহার করছে।

এ দিকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে তিনি ৭০০ মিলিয়ন ডলার নিজের অ্যাকাউন্টে সরিয়েছেন। রাজাক বলেছেন, এ অর্থ সৌদি সরকারের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া গেছে।

এবারের বিরোধী জোটের প্রচারণার মূল ইস্যু ছিল নাজিব প্রবর্তিত জিএসটি বাতিল এবং এক এমডিবি দুর্নীতির ইস্যু। অন্য দিকে সরকারি জোটের প্রচারের মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্রের স্থিতি ও ধারাবাহিকতা এবং চীনা আধিপত্য রোধ। উভয়পক্ষের প্রচারণার প্রভাব কমবেশি ভোটারদের ওপর পড়ছে। গত কয়েক বছরের বিরোধী জোট ও মাহাথিরের প্রচার-প্রচারণায় প্রধানমন্ত্রী নাজিবকে একজন দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা গেছে বলে মনে হয়। তবে এই প্রচারণা শহুরে মালয়দের যতটা প্রভাবিত করেছে ততটা গ্রামীণ মালয়দের প্রভাবিত করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তাদের কাছে বিরোধী জোটের মূল আবেদন হিসেবে কাজ করছে ক্ষমতায় যাবার একশত দিনের মধ্যে জিএসটি বাতিলের বিষয়টি। বিরোধী পক্ষ ক্ষমতায় গেলে চীনা প্রাধান্য সৃষ্টির প্রচারণাও গ্রামীণ মালয়দের কমবেশি প্রভাবিত করছে বলে অনেকের ধারণা।

এক সময়ের বিরোধী জোটের প্রধান শরিক পাস এবার পৃথকভাবে ছোট কয়েকটি সংগঠন নিয়ে জোট করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছে। সংসদের দুই তৃতীয়াংশ আসনে তারা নিজস্ব প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে।

a

প্রধান বিরোধী জোটের অভিযোগ, বিরোধী ভোট বিভাজনের জন্য নাজিব রাজাক বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিয়ে পাসকে আলাদাভাবে নির্বাচন করাচ্ছে। এই অভিযোগ নাজিব অস্বীকার করেছেন।

গত নির্বাচনে পাস পেয়েছিল ১৪ শতাংশ ভোট এবং ২১ আসনে জয়ী হয়েছিল। বিরোধী জোট থেকে বের হয়ে আসার প্রতিবাদে দলের প্রগ্রেসিভ নেতা হিকেবে পরিচিতরা আমানাহ নামে আলাদা দল করে বিরোধী জোটে যোগ দিয়েছেন। তাদের পক্ষে থাকেন সাতজন সংসদ সদস্য। এবারের নির্বাচনে পাসের প্রতিপক্ষ হিসেবে আমানাহ গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। বিরোধী জোট থেকে বের হয়ে আসার ফলে জাতিগত মিশ্র কোনো আসনে পাসের জয়ের সম্ভাবনা থাকল না।

অন্যদিকে মালয় প্রধান রাজ্য কেলানতান ও তেরাঙ্গানুতেও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে পাস । নতুন কোনো রাজ্য দখল তো দূরের কথা বহু বছর ধরে সরকারে থাকা কেলান্তানের ক্ষমতা হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে পাসের সামনে। এদিকে বিরোধী পাকাতান হারাপান রাজ্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী ও পাসের পরলোকগত আধ্যাত্বিক নেতা নিক আবদুল আজিজের জ্যেষ্ঠ পূত্র নিক ওমর রাজ্য পরিষদে প্রার্থী করেছে। পাকাতান জয়লাভ করলে তাকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করা হতে পারে। এর বাইরে পাসের প্রভাবশালী পাঁচ নেতার পুত্রকে মনোনয়ন দিয়েছে আমানাহ। সব মিলিয়ে পাসের ভোটারদের সমর্থনে দ্রুত ক্ষয় লক্ষ করা যাচ্ছে। পাসের স্বতন্ত্র নির্বাচনে বারিসান লাভবান হলেও দলটি বড় রকমের বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আমানাহ নেতারা এও বলছেন যে, পাকাতান জয়ী হলে তারা পাসকে আবার ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করবেন। পাস প্রধান আবদুল হাদি আওয়াংকে তারা ঐক্যের পথে প্রধান বাধা বলে মনে করেন।

মালয়েশিয়ায় এবারের নির্বাচনে ‘নির্বাচন কমিশনের’ ভূমিকা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন করতে হয় সমাজকল্যাণ দফতরে। কমিটি সংক্রান্ত কিছু তথ্য উপস্থাপন না করার অজুহাতে এই সরকারি প্রতিষ্ঠান মাহাথির মোহাম্মদের দলের নিবন্ধন বাতিল করে।

a

কমিশন বলেছে, বিরোধী জোট পাকাতান হারাপান নিবন্ধিত জোট না হওয়ায় এর নামে প্রতীক বরাদ্দ হয়নি। এর প্রার্থীরা জোটের সদস্য সংগঠন পিকেআরের প্রতীক ডাবল চাঁদকে প্রতীক হিসেবে নিয়েছে। এ যুক্তি দেখিয়ে বিরোধী জোটের প্রার্থীর পোস্টারে মাহাথির ও আনোয়ারের ছবি ব্যবহার করা যাবে না বলে ঘোষণা দেয় কমিশন। অনেক প্রার্থীও পোস্টারে এই দুই নেতার মুখে কালি মেখে দিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সময় দেয়া হয় ১৩ দিন।

আর বলা হয়, নির্বাচনী সমাবেশের ১০ দিন আগে সমাবেশের অনুমোদন নিতে হবে। এটি কার্যকর হলে ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচারণা বন্ধ থাকার ফলে একদিনই কেবল নির্বাচনী সমাবেশ করা সম্ভব হতো। বার কাউন্সিলের সমালোচনার মুখে অবশ্য এই আদেশ প্রত্যাহার করে কমিশন। এর আগে শাসক বারিসান জোটের সুবিধার্থে নির্বাচনী আসন পুনর্বিন্যাস করে বলে কমিশনের সমালোচনা হয়। নানা ধরনের বিতর্কিত পদক্ষেপ নেবার কারণে কমিশন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ও সংশয় রয়েছে বলে বিরোধী জোটের নেতারা অভিযোগ করেন।

বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত মোট ২২২টি সংসদীয় আসন এবং ৫৮৭টি প্রাদেশিক আসনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা এক কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৬২৭ জন। পোলিং সেন্টার থাকবে আট হাজার ৮৯৮ টি।

জেডএ/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।