চিকিৎসাসেবায় নিবেদিতপ্রাণ ডা. সামন্ত লাল সেন


প্রকাশিত: ১১:৫১ এএম, ২৬ জুলাই ২০১৫

তিনি পেশায় সরকারি একজন চিকিৎসক। তবে আট বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে চলে যান। এরপর টানা ছয় বছর একই প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করেন। দুই বছর আগে সেই চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।

তবুও প্রতিদিন সকালে হাসপাতালে ছুটে যেতেন তিনি। পরম স্নেহে রোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে সাহস জোগাতেন, রোগীদের মনোবল চাঙা করতে প্রচেষ্টা চালাতেন। পুরোনো সহকর্মীরা মুখ ফুটে কেউ কিছু না বললেও আড়ালে সমালোচনার সুরে বলতেন, চাকরি নেই তবুও কেন যে তিনি হাসপাতালে আসেন?

মাস ছয়েক আগের কথা। সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিরোধীদলের সহিংস আন্দোলন চলছে। সন্ত্রাসীদের ছুড়ে মারা পেট্রলবোমায় মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশু। খবর পেয়ে তাদের দেখতে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রোগী দেখার সময় কথা প্রসঙ্গে পূর্ব পরিচিত ওই চিকিৎসকের মুখে শুনতে পারেন তিনি বিনাবেতনে হাসপাতালে প্রতিদিন ছুটে আসেন। এ কথা জেনে চুপচাপ সেখান থেকে চলে যান প্রধানমন্ত্রী। কয়েকদিন পর তিনি ওই চিকিৎসককে হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট ইউনিটটির সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দেন।

বলছিলাম পোড়া রোগীদের চিকিৎসাসেবায় নিবেদিত এক প্রাণকর্মী চিকিৎসক ডা. সামন্তলাল সেনের কথা। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সেক্টরের সাধারণ চিকিৎসকের কাছে যিনি স্বনামে সুপরিচিত। সুদীর্ঘ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যিনি শুধুমাত্র পোড়া রোগীদের চিকিৎসাসেবায় আত্মনিয়োগ করে নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

একটু চেষ্টা করলেই তিনি অনায়াসেই অধ্যাপক হতে পারতেন। কিন্তু তা করতে গেলে সরকারি চাকরির শর্তানুযায়ী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে বদলি হতে হতো। তাই কখনই ন্যূনতম সে চেষ্টা করেননি। শুধুমাত্র পোড়া রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে একজন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পেশাগত জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি।

শনিবার জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ডা. সামন্তলাল সেন তার স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা নেই। পোড়া রোগীদের পাশে দাঁড়িয়ে চিকিৎসাসেবা দিতে পেরে মানসিক প্রশান্তি পেয়েছি, তেমনি জীবনটাও ধন্য হয়েছে।

তিনি বলেন, জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে। আমি চাকরিতে নেই শুনে তিনি আমাকে ঢামেক বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আমার কাজের স্বীকৃতির পাশাপাশি মহানুভবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

‘এ পুরস্কার আমার কাছে নোবেল প্রাইজের চেয়েও অনেক বেশি দামি। জীবনের বাকি সময়টুকু আমি পোড়া রোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত থাকতে চাই। ’

১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার ওসমানিনগর গ্রামে জন্ম ডা. সেনের। ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৮০ সালে তৎকালীন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।

ডা. সামন্তলাল সেন জানান, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসা দিতে এদেশে এসেছিলেন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন ডা. আর জে গাস্ট। মূলত তার হাত ধরেই এ অঙ্গণে প্রবেশ। ১৯৮১ সালে তিনি অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে ডিপ্লোমা ইন স্পেশালাইজড সার্জারি ডিগ্রি লাভ করেন।

স্মৃতিচারণকালে ডা. সেন বলেন, ১৯৮৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদান করেন। ওই সময় ঢামেক হাসপাতালের দোতলায় মাত্র ৮ শয্যার ওয়ার্ডে বার্ন ইউনিটে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকারের আমলে তিনিসহ অনেকের প্রচেষ্টায় ঢামেকের বস্তিঘর এলাকা থেকে ধীরে ধীরে বর্তমান ১০০ শয্যার ঢামেক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা হয়। এখানে প্রতি বছর হাজার হাজার পোড়া রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে। ডা. সেনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সরকারিভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি মেডিকেল কলেজে পৃথক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সম্প্রতি বার্ন বিশেষজ্ঞ তৈরির লক্ষ্যে পৃথক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ডা. সেন জানান, পোড়া রোগীদের দীর্ঘসময় ধরে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। পোড়া রোগীরা নিদারুণ শারীরিক ও ভীষণ মানসিক কষ্টে ভোগেন। তাদের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলে তিনি ভীষণ আনন্দ পান। রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় কেউ আনন্দে কেঁদে ফেলেন, কেউ পায়ে ধরে সালাম করে আশীর্বাদ নেন এটাই তার বড় পাওয়া।

ডা. সেন এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ে নবনিতা সেন বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সিঙ্গাপুরে থাকছেন। ছেলে অনাবিল সেন রাজধানীর গ্রীন লাইফ হাসপাতালের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ছেলে-মেয়েরা প্রথম প্রথম পোড়া রোগীদের নিয়ে সার্বক্ষণিক চিন্তা-ভাবনাটা পছন্দ না করলেও পরবর্তীতে তার কাজে উৎসাহ যোগান।

তিনি বলেন, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু দগ্ধ হয়। তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে দেড় সহস্রাধিক বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র ৫২ জন।

দেশে একটি পোড়া রোগীও যেন বিনা চিকিৎসায় মারা না যান এটাই তার শেষ ইচ্ছা বলে জানান ডা. সেন।

এমইউ/এসএইচএস/একে/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।