উন্নয়ন না সুশাসন
দেশে কোটিপাতির সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের একাত্তর টেলিভিশনের অর্থনীতি বিটের চঞ্চলা হরিণী কাবেরী মৈত্রেয় এমনি এক খবর দিল ক’দিন আগে। গত ছয় বছরে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। নতুন এ সংখ্যা যুক্ত হওয়ায় দেশে মোট কোটিপতির সংখ্যা এখন ৫৪ হাজার ৭২৭ জন।
উন্নতি বৈ কি ! আবার বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাংকের হিসেবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। কোটিপতির সংখ্যা বাড়ায় অর্থনীতিবিদরা বলবেন, এখানে অবৈধ অর্থের লেনদেনে বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যা, অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলবেন অর্থনীতির গতিশীলতার কারণে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা।
খুব সাধারণ মানুষেরা এমন স্বপ্ন ঘুণাক্ষরেও দেখে না। তারা চায় আয় বাড়বে, কাজের সুযোগ তৈরি হবে, জিনিসপত্রের দাম কমবে, পণ্য এবং পরিষেবা সরবরাহের সুষ্ঠু ব্যবস্থা হবে, সরকারি কাজকর্ম দক্ষ ভাবে সম্পন্ন হবে, দুর্নীতি থাকবে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল থাকবে ইত্যাদি।
আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কিন্তু ঠিক পরিষ্কার নয় আগের চেয়ে কাজের সুযোগ বাড়ল কিনা? যারা টাকাপয়সা খরচ করে লেখাপড়া শিখছেন বা ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, তাঁদের কাছে কিন্তু সেরকম কোনো সুখবর নেই। বিনিয়োগের চিত্র সুবিধার নয়, তাই কর্মসংস্থানের অবস্থাও তেমনি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন দ্বিগুণ করে দিয়েছে সরকার, কিন্তু দু’একটি খাত বাদে বেসরকারি খাতে অনেকদিন ধরেই মাইনেপত্র বাড়ে না। অর্থনীতির গতিভঙ্গ হলে মানুষ এমনিতেই বুঝে, কথা দিয়ে বুঝাতে হয় না।
শহরাঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, গ্রামাঞ্চলেও হচ্ছে। পল্লী অঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তার নানা কর্মকাণ্ডও আছে। এমন নানা রকম ভর্তুকির প্রকল্প চালিয়ে দারিদ্র পুনর্বণ্টন করা যায়, সত্যিকারের সমৃদ্ধি আনা যায় না। এই সত্যটি দেশের তরুণ প্রজন্মকে ভাবাচ্ছে বেশি। তারা প্রকল্প অর্থ বরাদ্দের কানাগলি থেকে বেরিয়ে গিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি চায়, উপযোগী সুশাসন চায়।
বাংলাদেশের খুব দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। সামাজিক অর্থনৈতিক পরিসরে নতুনত্ব আসছে, পুরনো সমাজকাঠামো ভেঙে যাচ্ছে, মানুষের চিন্তাভাবনা বদলাচ্ছে। গ্রাম আর শহরের মানুষের মানসিকতার পার্থক্যও কমে যাচ্ছে, বিশেষত তরুণদের ক্ষেত্রে। তাই কিছু নির্দিষ্ট এলাকা নয়, রাজধানী নয়, বড় শহর নয়, গোটা দেশ এখন উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে চায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্ন দেখানোর পথেই হাঁটছেন। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারি নজর আছে তা বুঝতে পারা যায়। কিন্তু তবুও দেখা যায় ভোটদাতাদের রাগ বা বিরাগ ক্ষমতাসীন সরকার বা দলের বিরুদ্ধেই যায়। এর কারণ দুর্নীতির ধারণা। উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা আছে, ক্ষমতাসীনরা দুর্নীতি অনিয়ম আর অনাচারকে সাথে নিয়ে চলছে।
গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে, স্বচ্ছতার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দুর্নীতি। হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপের টাকা আত্মসাত সামগ্রিক ভাবে প্রশাসনিক ব্যর্থতার নির্দেশনা দেয়, দেয় দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার বার্তা।
সরকার দরিদ্র মানুষের নামে অনেক প্রকল্প রেখেছে, অনেক ব্যয় করে। তবে একথাও সত্য যে গরিব মানুষের উন্নতিতে সরকার যত টাকা খরচ করে, তার বহু গুণ ব্যয় করে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের ভর্তুকি দিতে। আমাদের দেশে বড়লোকরা রাজনৈতিক ভাবে এত শক্তিশালী যে সরকারের হাতে টাকা থাকলে তার সিংহভাগ তারাই কেড়ে নেয়। তাই আয় বৈষম্য কমানোর যে কথা অর্থনীতিবিদরা বলেন সেখানে গরিব মানুষের গলা খুব একটা শোনা যায় না।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো যখন আর্থিক কর্মকাণ্ড বাড়ে, তখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদাও বাড়ে। সেগুলো ক্রমশ বহু মূল্যবান হয়ে ওঠে। আর সেসবকে কেন্দ্র করে মাফিয়াচক্র তৈরি হয়। তাই জমি দখল হয়, বন উজাড় হয়, ব্যাংকের টাকা লোপাট হয়। অর্থনীতির এই টানাপোড়েনের খেলা রাতারাতি বদলায় না, কিন্তু যারা পরিচালকের আসনে আছেন, তাদের নজরটা আছে কিনা চুরি-ডাকাতি কমাবার সেটাই বড় কথা।
উন্নয়ন ছাড়া যেমন সুশাসন নিশ্চিত করা যায় না, তেমনি সুশাসন ছাড়া উন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করা যায় না। দুটিই পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। উন্নয়ন কষ্টসাধ্য হলেও অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু সুশাসন প্রতিষ্ঠা জনকল্যাণকামী বড় বড় রাষ্ট্রনেতাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। সেই পথ চিনে নিতে হবে শীঘ্রই।
এইচআর/এমএস