২৮ প্রতিষ্ঠান গ্রাস করছে ঐতিহ্যবাহী করতোয়া নদী!
২৮ ব্যক্তি মালিকানাধীন স্থাপনা খেয়ে ফেলেছে বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী করতোয়া নদী। দখলদাররা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রশাসনও তাদের কাছে ছিল অসহায়। যার কারনে খরস্রোতা করতোয়া নদী হারিয়ে গেছে বহু আগেই। আদালতে মামলা চলছে। এই সুযোগে করতোয়ার বুকে উঠছে আরো নতুন ভবন। বগুড়া জেলা প্রশাসনের জরিপ অনুযায়ী সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দখল হয়ে যাওয়া করতোয়া নদীর জমির পরিমাণ প্রাায় সোয়া ৫ একর।
এদিকে অনেক জল্পনা কল্পনার পর বৃহস্পতিবার থেকে করতোয়া নদীর দুইপাড়ে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। শহরের নওয়াব বাড়ি ঘাট সংলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠা একটি প্রাচীর ভেঙে ফেলার মাধ্যমে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হয়। তবে এই অভিযানে ২৮টির স্থলে মাত্র ৬টি স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাবিবুল হাসান রুমি জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, অবৈধ দখলদারের তালিকা ধরে উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
অনুসন্ধান করে গেছে, স্বাধীনতার পর থেকেই করতোয়া নদীর জায়গা দখল শুরু হয়। করতোয়া নদীকে দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ডায়াবেটিক হাসপাতাল। বেসরকারি সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের (টিএমএসএস) সুবিশাল ভবন নির্মিত হয়েছে করতোয়া দখল করে। এছাড়া সিনেমা হল, বাড়ি, কারখানা, গোডাউন নির্মাণ করা হয়েছে। এসপি ব্রিজ এলাকায় নদীর মধ্যে সীমানা প্রাচীর দিয়ে জায়গা দখল করেছেন একজন চিকিৎসক। মালতিনগর চাঁনমারীঘাট এলাকায় নদীদখল করে আছে শহরের মাটি ও বালু ব্যবসায়ীরা। ফতেহ আলী সেতু এলাকায় দখল করে এক ব্যবসায়ী গড়ে তুলেছে বিশাল গুদাম, বাড়ি, ময়দার মিল ও কারখানা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বগুড়া পৌরসভা ও প্রশাসনের সঠিক নজরদারির অভাব এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই করতোয়া ক্রমশই হারিয়ে যেতে বসেছে।
জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখা সূত্র জানায়, করতোয়া নদীদখলের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে সর্বশেষ গত বছরের জুলাই মাসে ২৮ দখলদারের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একটি জরিপ দল গঠন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই দল জরিপ করে চলতি বছরের জুন মাসে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে ২৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দখলদার হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দাখিল করেন।
দখলদারদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)। তারা প্রায় ৫ একর জমিদখল করে রেখেছে। এর মধ্যে মহিষবাথান মৌজায় ১৫৫৩ দাগে ৪ দশমিক ৯০ একর, নবাববাড়ী মৌজায় ১৭১৬ দাগে পৌনে এক শতক দখল করে পুকুর, ছাত্রাবাস, ক্যান্টিন নির্মাণ করে ব্যবসা করছে।
সূত্রাপুর এলাকার ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ প্রায় দেড় শতক জমি দখল করে সীমানা প্রাচীর দিয়েছেন। ফুলবাড়ীর খয়রুজ্জমান ৯৬ বর্গফুট, রাজাবাজারের আব্দুস সোবাহান ৫৪৬ বর্গফুট, শংকর বাবু ও কানাই লাল মিলে ৭১ বর্গফুট দখল করে চালাঘর ও পাকা ভবন নির্মাণ করেছেন। একইভাবে ফতেহ আলী আল আরাবিয়াতুন খালাফিয়া ওয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদে মোবারক নামে ২০৯ বর্গফুট, নবাববাড়ী সড়কের একেএম ফজলুর রহমান ৮০ বর্গফুট, মোক্তার হোসেন ২৪ বর্গফুট, জোবাইদুল ইসলাম ৫০০ বর্গফুট, মতিয়ার রহমান ৯০০ বর্গফুট, মাজেদ হোসেন ১৮০ বর্গফুট, ডায়াবেটিক হাসপাতাল ৩৫০০ বর্গফুট, গুপিনাথ মন্দিরের সভাপতি আনন্দ ৪০৯ বর্গফুট, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টিএমএসএস ৩৭৮ বর্গফুট, সঞ্জীব কুমার বিহানী ২৪০ বর্গফুট, প্রদীপ কুমার রায় ৫৪৪ বর্গফুট, আব্দুল জলিল ১৫০ বর্গফুট জায়গা অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন। সব মিলিয়ে দখলের পরিমাণ সাড়ে ৫ একর। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা।
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হায়াত-উদ-দৌলা খান জাগো নিউজকে বলেন, করতোয়া নদীর দখলদারদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া উচ্ছেদ মামলা হওয়ার পর শুনানির জন্য সবাইকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে কয়েকজনের শুনানি করা হয়েছে। কেউ কেউ আবার মাপজোকের আবেদন করেছিলেন। আবার কেউ নদী দখলের অভিযোগ অস্বীকারও করেছেন। সবকিছু যাচাই-বাছাই করে দখলদার প্রমাণিত হয়েছে যারা তাদের বিরুদ্ধেই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
বগুড়া সদর উপজেলার সাবেক ইউএনও আবদুর রহিম বলেন, মাপজোক করে টিএমএসএসের প্রধান কার্যালয়ে ১৮ শতকের মতো এবং শহরের নওয়াববাড়ি সড়কের বিসিএল বিপণি কেন্দ্রের পাশে সাড়ে তিন শতকের মতো করতোয়া নদী দখলের প্রমাণ মিলেছিলো। তবে তিনি এখনকার অগ্রগতি বলতে পারবেন না।
তবে জেলা প্রশাসনের বর্তমান দখলদার তালিকা অসম্পূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া জেলা কমিটির সভাপতি সামির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, তালিকাটি রীতিমতো বিস্ময়কর। বড়বড় প্রভাবশালী দখলদারদের আড়াল করতে এটি করা হয়েছে।
তবে অভিযোগ সম্পর্কে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হায়াত-উদ-দৌলা খান বলেন, দখলদার চিহ্নিত করতে কোনো অনিয়ম হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে টিএমএসএসের নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, বিসিএল মার্কেট সংলগ্ন ওই স্থানে করতোয়ার জায়গায় কোনো স্থায়ী বা পাকা ইমারত নির্মাণ করা হয়নি। নদীরপাড় সংলগ্ন অব্যবহৃত কিছু জায়গায় এখনো খুঁটি ও টিন দিয়ে নির্মিত অস্থায়ী স্থাপনা রয়েছে। তবে সরকার চাইলে যেকোনো সময় স্থাপনাটি সরিয়ে নেওয়া হবে। সংস্থার প্রধান কার্যালয় এলাকায় নদী দখলের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, নদীর যে জায়গা দখলের কথা বলা হচ্ছে ওই জায়গাটুকু সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিয়েছে টিএমএসএস। ওই ইজারার পক্ষে নিম্ন আদালতে একটি মামলার রায়ও রয়েছে আমাদের পক্ষে। রায়ের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ হাইকোর্টে আপিল করেছে।
করতোয়া নদীর দ্বিতীয় শীর্ষ দখলদার হলো বগুড়া ডায়াবেটিক সমিতি। এই প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণে আছে নদীর সাড়ে ছয় শতক এলাকা। সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম গোলাম রসুল খান বলেন, নদীর গতিপথ বা স্রোতধারা বাঁধাগ্রস্ত হয়নি। সে কারনে ভবন করা হয়েছে।
এমজেড/পিআর