রহস্যময় বিয়ের গল্প
বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বিয়ের অনুষ্ঠানের একদম নিখুঁত আয়োজন। কিন্তু এ বিয়ের আয়োজনের আড়ালে লুকিয়ে আছে গোপন এক রহস্য। ২৭ বছর বয়সী খা’ তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা; সিঙ্গেল মা হতে যাচ্ছেন তিনি। ভিয়েতনামের এ তরুণী সামাজিক কলঙ্ক এড়ানোর লক্ষ্যে বিয়ের আসর সাজিয়েছেন। গোপন রহস্য হচ্ছে, এ বিয়েতে তার বাবা-মা, ভাই, বোন, এমনকি বরও ভাড়ায় জোগাড় করেছেন তিনি।
সামাজিকভাবে রক্ষণশীল ভিয়েতনামে চিরা-চরিত ঐতিহ্য ভেঙে একক মা হওয়ার মূল্য তার পরিবারের জন্য উচ্চ হতে পারে। দেড় হাজার ডলার খরচ করে বিয়ের আয়োজন সম্পন্ন করেছেন খা। এই অর্থ খরচ করেছেন তার সন্তানের বাবার জন্য; যিনি অন্য এক নারীকে বিয়ে করেছেন। বিয়ের এক মাস পর বার্তাসংস্থা এএফপিকে খা বলেন, ‘আমি যদি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাই এবং স্বামী ছাড়া, তাহলে আমার বাবা-মা প্রথমেই প্রচুর লজ্জা পাবেন।’
ভিয়েতনামের বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য অতিথি ভাড়ার ব্যবসা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। দেশটির ১৫ বছর বয়সের ঊর্ধ্বের প্রায় ৭০ শতাংশই নাগরিকই বিবাহিত। তবে অনেক নারীই গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন যারা বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়েননি। খা তাদের একজন।
তরুণ জুটিরা হাজার হাজার ডলার খরচ করছেন শুধুমাত্র পারিবারিক চাপ লাঘবের জন্য। বিয়েতে আগ্রহী নন এমন অনেক তরুণ-তরুণী সামাজিক ঐতিহ্য রক্ষায় ও আইনি ঝামেলা এড়াতে বাবা-মা, ফুফা-ফুফু, চাচা-চাচী এমনকি বন্ধু ভাড়া করে আনুষ্ঠানিকভাবে ভুয়া বিয়ে করছেন।
খা এবং তার ভুয়া স্বামী আইনিভাবে বিয়ে করেননি। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার জন্য ভিয়েতনামে জমকালো আয়োজনে বিয়ে করেছেন তারা। বন্ধু-বান্ধব ও স্বজনদের সামনে বিয়েতে অংশ নেয়ার জন্য খা তার ভুয়া স্বামীর প্রতি চির-কৃতজ্ঞ।
হাসতে হাসতে ভিয়েতনামের এ তরুণী বলেন, ‘মনে হচ্ছিল আমি ডুবে যাচ্ছি কিন্তু জীবন রক্ষাকারী একটি লাইফজ্যাকেট আঁকড়ে ধরলাম।’ পরিচয় গোপন রাখতে খা তার প্রকৃত নাম প্রকাশ করেননি।
তবে খা’র বিয়ের আড়ালে যে গোপন রহস্য আছে তা তার বাবা-মা জানেন। কিন্তু খা যে সিঙ্গেল মা হতে যাচ্ছেন তার পেছনের একটি গল্প পরিবারের অন্যদের কাছে জানানোর জন্যই ভুয়া বিয়ের আয়োজন করেছেন। খা বলেন, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে মা হতে যাচ্ছেন সেটি আড়াল করতে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মা হচ্ছেন এমন গল্প পরিবারের অন্যদের কাছে জানাতেই এ আয়োজন করেছেন তিনি।
প্রজন্মের ব্যবধান
ভিয়েতনামে তরুণদের মধ্যে সম্পর্কের রীতি-নীতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। দেশটির ৯ কোটি ৩০ লাখ মানুষের অর্ধেকের বয়স ৩০-এর নিচে।
বিয়ের আগে অধিকাংশ দম্পতিই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসবাস করলেও বিয়ের পর পাল্টে যায় এ চিত্র। ভাড়ায় নেয়া অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করতে শুরু করেন তারা। দেশটিতে গর্ভপাতের হারও অনেক বেশি, গত বছর দেশটিতে ৩ লাখ গর্ভপাতের ঘটনা সরকারি নথিভূক্ত হয়েছে। তবে দেশটিতে সামাজিক কুসংস্কার এখনো উচ্চ।
কিন্তু যখন বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যাপার আসে; তখন ঐতিহ্য রক্ষায় অনেকেই পারিবারিক ও সামাজিক চাপের মুখে পড়েন। বিশেষ করে এ চাপ আসে সমাজের অতি-রক্ষণশীল প্রবীণদের কাছ থেকে।
মনস্তাত্ত্বিক গবেষক এনগুয়েন ডাই কিওয়ং বলেন, ‘হৃদয়ে সত্য ধারণের সাহস নেই মানুষের, তারা সামাজিক এতিহ্যগত অভ্যাস, রীতি-নীতি, সংস্কৃতি এবং দৃষ্টিভঙ্গির মুখোমুখি।’
এই চিরাচরিত রীতি-নীতি বেরিয়ে আসতে যারা সাহস পাচ্ছেন না এবং পারিবারিক ফাঁটল এড়ানোর জন্য এ ধরনের বিয়ের অভিনয় করছেন তাদের প্রতি সহানুভূতি জানান এ গবেষক।
হুওং ও তার বন্ধু কুয়ানের সঙ্গে একই ধরনের ভুয়া বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। তবে দরিদ্র প্রদেশের এ তরুণীকে মেনে নিতে পারেনি হুওংয়ের পরিবার। পরে ওই তরুণী তার জন্মস্থান এনঘে অ্যান প্রদেশে একটি ভুয়া বিয়ের আয়োজন করেন। তবে এ বিয়েতে ঠিক কত অর্থ খরচ হয়েছিল তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তারা। হুওংয়ের বিয়েতে আগত অতিথিরা ছিলেন তার আত্নীয়-স্বজন। কিন্তু তার বাবা-মা, ফুফা-ফুফু, চাচা-চাচী ও বন্ধু হিসেবে যারা উপস্থিত ছিলেন; তারা সবাই ভাড়ায় আসেন।
তিক্ত এই অভিজ্ঞতা স্বত্ত্বেও কুয়ান বলেন, ‘তাদের প্রতিশ্রুতি মিথ্যা নয়।’ গত মাসে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষের পর তিনি বলেন, এটাতে সত্য এবং মিথ্যা, উভয়ই ছিল। যদিও ভবিষ্যতে বাবা-মার প্রত্যাশা কীভাবে পূরণ করবেন সেব্যাপারে কিছুই জানেন না তিনি।
টাকায় মিলে ভুয়া বিয়ের আয়োজক
ভিয়েতনামের অন্যতম একটি কোম্পানি হচ্ছে ভিনামোস্ট; যারা ৪ হাজার ৪০০ ডলারের বিনিময়ে একটি বিয়ের পুরো প্যাকেজ সেবা দেয়। এ কোম্পানির কাছে থেকে শত শত ভিয়েতনামি তরুণ-তরুণী ভুয়া বিয়ের প্যাকেজ কিনেন।
ভিনামোস্টের প্রতিষ্ঠাতা এনগুয়েন জুয়ান থিয়েন বলেন, গত কয়েক বছরে তারা এ ধরনের হাজার হাজার বিয়ের অনুষ্ঠান করেছেন। তবে ভিয়েতনামজুড়ে বছরে ঠিক কতগুলো ভুয়া বিয়ের অনুষ্ঠান হয় সেব্যাপারে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই।
এক দশক আগেও এসব বিয়ের আয়োজনে এক ডজনেরও কম অতিথি ভাড়া করা হতো। কিন্তু এ ব্যবসার প্রসার ঘটেছে ব্যাপক; বর্তমানে চারশ’র বেশি অতিথি ভাড়া করা হয় ।
আগামী এপ্রিলে মা হবেন খা। মিথ্যা থেকে ভুয়া বিয়ে তাকে বাঁচিয়েছে বলে মন্তব্য করেন। ভিয়েতনামের এ তরুণী বলেন, ‘আমার গর্ভধারণের ব্যাপারটি লুকিয়ে রাখা ছিল অত্যন্ত বিরক্তিকর। তবে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন আমি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।’
এসআইএস/পিআর