আস্তে আস্তে চারদিকের সফল লোকগুলো বিদায় নিচ্ছে


প্রকাশিত: ০৭:৫৬ এএম, ১৫ জুলাই ২০১৫

মেজর জেনারেল (অব.) আমজাদ খান চৌধুরী, আমি যাকে জেনারেল আমজাদ বলতাম, কয়েক দিন আগে দীর্ঘ রোগ ভোগের পর মারা গেলেন। এই জেনারেল আমজাদ ছিলেন অনেক কিছুতেই ব্যতিক্রম। অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ী লোক ছিলেন। সেনাবাহিনীর উচ্চপদ থেকে অবসর নিয়ে অ্যাগ্রোবেজড প্রডাক্টসের ব্যবসায় নেমেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় সেই অনেক আগে, সম্ভবত ১৯৮৮ সালের দিকে। জেনারেল আমজাদ আর কম্পানির চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দীন বসতেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার বিল্ডিংয়ে। জেনারেল আমজাদের প্রতিষ্ঠিত কম্পানির নাম `প্রাণ`। তিনি `প্রাণ` শব্দ কোন কোন শব্দের প্রথম অক্ষর নিয়ে গঠিত, সেটা আমার কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন, শুনেই বুঝে নিয়েছিলাম জেনারেল আমজাদ দেশে পাওয়া যায় এমন ফলমূল থেকে নানা ধরনের প্রডাক্ট তৈরি করতে চাচ্ছেন। আমাকে `আবু ভাই` বলে ডাকতেন। বললেন, আবু ভাই, আমি তো করতে চাচ্ছি, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। জেনারেল একটি বিদেশি কম্পানির ফলের রসের প্যাকেট দেখিয়ে বললেন, এ ধরনের প্যাকেট বাংলাদেশে তৈরি করা যায় না। তবে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। কয়েক মাস পর দেখলাম এক ইউরোপিয়ান তাঁর অফিসে ঘোরাফেরা করছেন। জিজ্ঞাসা করে জানলাম ওই বিদেশি একজন টপ টেকনোক্র্যাট, (Technocrat) প্রাণের প্রডাক্টসের বহুবিধকরণ ও প্যাকেজিংকরণে কৌশলগত সাহায্য করছেন। কয়েক বছর পর প্রাণ গ্রুপের প্রধান অফিস ইত্তেফাকের পূর্ব পাশে টিকাটুলীতে স্থানান্তরিত হয়। ওই অফিসের মালিক প্রাণ নিজেই ছিল।

প্রথম দিকে প্রাণ গ্রুপ রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা বা ঘরবাড়ি-ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজও করেছিল। কিছু দিন পর দেখলাম আরো জৌলুশ নিয়ে ফ্ল্যাট নির্মাণের ক্ষেত্রে অন্য আরেক কম্পানির আবির্ভাব হলো। জেনারেল বললেন, প্রাণে যাঁরা চাকরি করতেন তাদের কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেরাই রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা শুরু করেছেন। প্রাণের ঘরবাড়ি-ফ্ল্যাট নির্মাণের সেই উদ্যোগ আজও আছে কি না জানি না। আমার জানামতে, বেশ কয়েকটি রিয়েল এস্টেট কম্পানি একেবারে প্রথম দিকে এই ব্যবসায় নেমেও পরে এই ব্যবসা থেকে সরে এসেছে। যারা রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, তাদের মধ্যে ইস্পাহানি ও বেক্সিমকো গ্রুপ অন্যতম। কেন তারা এই ব্যবসা ছেড়ে দিল সেটা আমার বোধগম্য নয়।

এরপর এই সেক্টরে আরো কয়েক শ কম্পানির উদ্ভব হয়েছে। অনেকেই এই ব্যবসা করে সফল হয়েছে। অনেকেই আবার ব্যর্থ হয়েছে। এখন জমি ও ফ্ল্যাটের ব্যবসার মন্দা যাচ্ছে। মন্দার জন্য এই ব্যবসায় লিপ্ত কম্পানিগুলোই দায়ী। তারা অর্থনীতির আগে দৌড়িয়েছে। চাহিদার কথা না ভেবে সমানে ফ্ল্যাট তৈরি করেছে। প্লটের মালিকদের উচ্চমূল্য দিতে গিয়ে তাদের নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে মূল্য কমিয়েও তাদের সব তৈরি ফ্ল্যাট বেচতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ একটা ন্যূনতম মূল্যের নিচে তারা যেতে পারে না। ফলে এই খাতে চাহিদা-সরবরাহের মধ্যে একটা অমিলন ঘটেছে। পরিষ্কার হতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে; যদি ফ্ল্যাট নির্মাণে নিয়োজিত কম্পানিগুলো ইতিমধ্যে আর অতিরিক্ত ফ্ল্যাট তৈরি না করে।
যা হোক, বলছিলাম জেনারেল আমজাদের কথা। সড়ক পরিবহন সংস্থার ভাড়া অফিসে থাকার সময় আমার মনে হতো, জেনারেল সাহেব যে পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন তা তাত্ত্বিকভাবে অতি ভালো, কিন্তু বাস্তবে তিনি এগোতে পারবেন কি! আমাদের দেশের ভোক্তারা বোতলে শুধু ফানটা আর পেপসি পান করা জানে। তারা চায়ে চিনি-দুধ মিশিয়ে খেতে পছন্দ করে। কিন্তু ফলের রস বোতলে বা কাগজের তৈরি প্যাকেটে খেতে চাইবে কি? তবে ভাবতাম ঠিকমতো উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারলে এই ব্যবসাও হতে পারে। কিন্তু এই ব্যবসা এত বড় হতে পারে তা আমার ধারণায় ছিল না। পরে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমি যখন দেখলাম লোকে মিনারেল ওয়াটারের নামে বোতলের পানি পান করা শুরু করেছে, তখন ভাবলাম জেনারেল আমজাদের ধারণাই সঠিক হবে। লোকে কোক-পেপসি পান করতে পারলে বোতলের ফলের রস কেন পান করবে না? পানির ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া আর একজন কর্নেল, নাম কর্নেল মালেক; তিনি পরে ঢাকা সিটি করপোরেশনেরও মেয়র হিসেবে কাজ করেছেন।

কর্নেল মালেক আমাকে বলতেন যে দেশে পানি সর্বত্র পাওয়া যায় সেই দেশে লোকে প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করবে কেন, তাও অর্থ দিয়ে কিনে? এই কর্নেল মালেক অন্য আরো একটা ব্যবসা প্রথম এই দেশে শুরু করেছিলেন, সেই ব্যবসা হলো থাই অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবসা। তিনি এই পণ্য উৎপাদনের জন্য একটি ফ্যাক্টরিও স্থাপন করেছিলেন। আমরা সেই কালে ওই থাই অ্যালুমিনিয়াম কম্পানির গর্বিত শেয়ারহোল্ডার ছিলাম। মালেক সাহেবের পানি বেচার ব্যবসা সফল হয়েছিল। আজকে মালেক সাহেবও প্রয়াত।  তবে তাঁর পানি বেচার ব্যবসা এখন অন্যরা অনেক বড় পরিসরে করছে। এই দেশের লোকে এখন অর্থ দিয়ে পানি কিনে খেতে অভ্যস্ত হয়েছে। মালেক সাহেবের কাছেও বিদেশিরা ঘুরঘুর করতেন এই পানি বেচা ব্যবসা বোঝানোর জন্য। সেই এক বিদেশির সামনেই তিনি আমাকে বলেছিলেন, এই দেশে বোতলের পানির ব্যবসা চলবে কি না। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল বটে, তবে বাস্তবে আমি কোনো দিন ব্যবসা চালিয়ে দেখিনি। বইয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে আমি যা পড়েছি তাতে আমার মনে হতো ব্যবসার ক্ষেত্রে আমার মতো লোক ফেলই করবে।

আমার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পরিচয়ের দুটো কারণ ছিল। এক. আমি যদিও শিক্ষক বা একাডেমিক ছিলাম, কিন্তু আমি বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে অনেক লিখতাম। আমি বেসরকারি খাতের পণ্যের নীতিসহায়তা প্রদান নিয়ে অনেক লিখতাম বলে সিনিয়র ব্যবসায়ীরা আমাকে ডেকে কথা বলতেন, তাদের সেমিনারেও আমাকে দাওয়াত দিতেন। অন্য কারণ ছিল, সে প্রশ্ন থেকেই শেয়ারবাজারের প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। এই বাজারের সংস্কার চেয়ে আমি বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করেছি। তখন শেয়ারবাজার বলতে তেমন কিছুই ছিল না। অথচ আমার শিক্ষাগত জ্ঞান বলেছে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কার্যকর একটি শেয়ারবাজার প্রয়োজন। এই দুই কারণে আমার ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। তবে দুঃখ ও বাস্তবতা হলো অনেক ব্যবসায়ী আত্মকেন্দ্রিক ব্যবসা করতে ব্যস্ত ছিলেন। শুধু নিজের লাভটাই দেখতেন। সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী করা উচিত সে ব্যাপারে তাঁদের জ্ঞান ও ইচ্ছার ঘাটতি ছিল। ফলে আমাদের অর্থনীতিতে সংস্কারগুলো আসতে দেরি হয়েছে। আজকে আমাদের অর্থনীতি প্রায় পূর্ণাঙ্গভাবে সংস্কারকৃত। এখন বাজার অনেক বেশি উন্মুক্ত। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে এমনটি ছিল না। বন্ধ বাজার সবে খুলতে শুরু করেছে। ধাক্কাগুলোকে আরো জোরে দিলে দুয়ার অনেক আগেই খুলে যেত।

অর্থনীতি নিয়ে লিখতে গিয়ে আমি আরো একটি বিষয় লক্ষ করেছি, তা হলো সংস্কারগুলো যতটুকু আসছে ওগুলো আসত বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের শর্তের কারণে। অনেক অবাক হয়ে ভাবতাম, যে সংস্কারগুলো আমাদেরই করার কথা, সেগুলোর জন্য ঋণ বা সাহায্যদাতারা বলবে কেন? আসলে বরাবরই আমাদের ওপরের নেতৃত্বের মধ্যে এই ক্ষেত্রে বুঝের অভাব ছিল। বুঝের অভাব না থাকলে তো এত দিনে বিশাল বাংলাদেশ এয়ারলাইনস আংশিক হলেও ব্যক্তি খাতে গিয়ে শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হতো। বুঝের অভাব না থাকলে সোনালী-জনতা-অগ্রণী-রূপালী আরো চারটি ব্যাংক আগে সরকারি মালিকানায় থেকে বড় বড় চুরির জন্য সুযোগ তৈরি করে দিত না। ইতিমধ্যে দুটো ব্যাংক ব্যক্তিমালিকানায় এসে শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হয়েছে।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের দোদুল্যমানতার কারণে আমলারাও এ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। ফলে সরকার সময়ের ব্যবধানে অনেক বড় হয়েছে সত্যি, কিন্তু সেই বড় সরকার সেটা যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় রাখতে চেয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে অর্থনীতির। বিরাট এক সরকারি খাত অর্থনীতির ওপর বোঝা হয়ে বসে থাকলে অর্থনীতির জনজীবনের পক্ষে তীব্রগতিতে দৌড়ানো সম্ভব নয়। জেনারেল আমজাদ আর কর্নেল মালেক ছিলেন এ দেশের জন্য প্রথম প্রজন্মের শিল্পপতি; এই জেনারেশনে ঢোকার জন্য এখনো বেঁচে আছেন। অন্য জেনারেশনের অন্যতম আর এক পুরোধা ছিলেন প্রয়াত স্যামসন এইচ চৌধুরী, যিনি স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা।

এক অতি ভদ্রলোক ছিলেন স্যামসন চৌধুরী। সৎ ছিলেন, পরিশ্রমী ছিলেন, চলতেন অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে। যে কম্পানিতে স্যামসন চৌধুরী আছেন সেই কম্পানির শেয়ার আমরা কিনতে চাইতাম। কারণ ছিল স্যামসন চৌধুরীর প্রতি আস্থা। তিনি আমাকে কালিয়াকৈরের ফার্মাসিউটিক্যাল কম্পানির ফ্যাক্টরি দেখাতে নিয়ে গেলেন। যেতে যেতে যেসব কথা তাঁর কাছ থেকে শুনলাম ও যেসব চালচলন তাঁর দেখলাম তাতে আমার মনে হয়েছে, স্কয়ার কম্পানির শেয়ার কিনলে বিনিয়োগকারীদের লাভ হবে। কারণ স্যামসন চৌধুরী অন্যের টাকাকে নিজের টাকা মনে করতেন না। অন্যের টাকায় অন্যের জন্য কিছু করতে হবে, এটা সব সময় তাঁর মাথায় থাকত। তারপর তিনি স্কয়ার হাসপাতাল নির্মাণ করলেন। বেশ কয়েক বছর এই হাসপাতাল মুনাফায় ছিল না। পরে মুনাফা এসেছে। আজ এই হাসপাতাল নিয়ে জাতি গর্ব করতে পারে।
তিনি দুঃখ করে বলতেন, সরকার নাকি স্কয়ার মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন দেয়নি। পরে সেখানে তিনি নার্সিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। স্যামসন চৌধুরী সৎ ছিলেন। নিজে দুর্নীতি করেননি। দুর্নীতির জন্য কোনো ব্যয় বহন করতেও তিনি রাজি ছিলেন না। স্যামসন চলে গেলেন কয়েক বছর আগে। আমজাদ খান চলে গেলেন কিছুদিন আগে। কর্নেল মালেক আরো অনেক আগে, এভাবে আমাদের প্রথম জেনারেশনের ব্যবসায়ী-বিত্তবানদের মধ্যে একে একে সবাই ইহজগৎ ত্যাগ করছেন। একেকজন চলে যাচ্ছেন, মনে হচ্ছে একেকটা এক বড় শূন্যতা তৈরি হচ্ছে।

প্রথম দিকে মনে হতো বাংলাদেশে তাঁরা যা চাইছে সেটা হওয়ার নয়। তাঁদের ব্যবসা হবে, তবে সেই আকারের। আজকে আমার সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আজ প্রাণ একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড। যখন ভারতের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রাণের প্রডাক্টসের বিজ্ঞাপন দেখি তখন গর্বে মনটা ভরে যায়। মনে মনে ভাবি বাংলাদেশিরাও পারে। আর স্কয়ার ফার্মার ওষুধ তো অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের FDA-এর অনুমোদন পেয়েছে। এটা স্কয়ারের জন্য একটা বড় অর্জন, বাংলাদেশের জন্যও বড় অর্জন। বাংলাদেশ এগিয়েছে। এগিয়ে যাবে তাদের দেখানো পথ ধরে। আমার বিশ্বাস, সামনের দিনগুলো আমাদের ব্যবসাটাকে গ্লোবালাইজ করার ক্ষেত্রে অনেক সহজ হবে। আমি জেনারেল আমজাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করি। সফল তাঁরা হয়েছে এবং সেটার জন্য বাংলাদেশ সফল হবে। সূত্র : কালের কণ্ঠ

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।