সাদা সেমাইয়ে রঙিন স্বপ্ন


প্রকাশিত: ১২:২৬ পিএম, ১৩ জুলাই ২০১৫

রঙটা সাদা। তবে স্বপ্নটা রঙিন। একদিন এটি ছিলো গরীব মানুষের ঈদ আয়োজন সঙ্গী। এখন মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সব মানুষের ঘরে ঈদ আয়োজনের সঙ্গী। পণ্যটি হলো চিকন সেমাই। বগুড়ার দইয়ের মতোই সেরা চিকন সেমাই। দেশজুড়ে আছে এর খ্যাতি। আর ঈদের খাবারের মেন্যুতে অবশ্যই থাকা চাই সেমাই। এ কারণে ঈদ এলেই বেড়ে যায় বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের চাহিদা।

শহরতলী ও উপজেলা সদরের বিভিন্ন গ্রামে সেমাইয়ের কারিগরদের এখন একদম দম ফেলার ফুরসত নেই। দিনে রাতে সমানে কাজ। দিনের আলোয় সেমাই না শুকানো গেলে বিশেষ ব্যবস্থায় হিট দিয়ে শুকানো হচ্ছে। সেমাই তৈরির বেশিরভাগ কারিগর নারী। দেশের প্রতিটি জেলা থেকে পাইকাররা আসছেন সেমাই কেনার জন্য। রাজধানী ঢাকা, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও খুলনার ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত ট্রাকে করে সেমাই নিয়ে যাচ্ছেন। বগুড়ার অনেক গ্রামে এখন চিকন সেমাই কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। কুটির শিল্পের মাধ্যমেই এই সেমাই দেশে ও বিদেশে চাহিদা মিটাচ্ছে।

বগুড়া শহরের বিভিন্ন স্থানে সেমাই তৈরি করা হলেও চিকন সেমাই গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে বেজোরার সেমাইপল্লী। প্রতিবছর ঈদের সময় এই গ্রামে দেখা যায় বক সাদা রঙের চোখ ধাঁধানো পরিবেশ। সাদা সেমাই বানাতে ব্যস্ত প্রতিটি পরিবার। বগুড়ার চিকন সেমাই যাচ্ছে সারা দেশে। সেমাই বিক্রির জন্য গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য দোকান। এ মৌসুমেই কয়েক কোটি টাকার সেমাই বিক্রি হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

তারা জানান, দুই বছর আগেও যে সেমাই বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা, এখন সেই সেমাইয়ের কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এরপরও মুখরোচক এই খাবারের চাহিদা কমেনি।

বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের কদর দেশজুড়ে। সেমাই পল্লীতে প্রায় ১শ কারখানায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ৫০০ নারী শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছেন। তাদের হাতের ছোঁয়ায় ময়দা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে চিকন সেমাই। সারা বছর উৎপাদিত হলেও রমজান এবং ঈদ মৌসুমে সেমাইর চাহিদা ৫ গুণ বেড়ে যায়। মূলত শবেবরাতের পর থেকেই শুরু হয় সেমাইয়ের উৎপাদন। গ্রামের প্রতিটি বাড়িই একেকটি কারখানা। আর প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন গড়ে ৪৮০ থেকে ৫০০ কেজি অর্থাৎ ২০ খাঁচা করে সেমাই তৈরি হয়ে থাকে।

বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের ইতিহাস বেশি দিনের নয়। আশির দশকের শুরুতেও রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতরের দুদিন আগে শহরের রেলগেটের দুই ধারে গ্রামের কিছু লোক বাঁশের ঝুড়ির ভাড়ে করে সেমাই এনে পসরা সাজিয়ে বসতেন। সাধারণত মধ্যবিত্ত, স্বল্প আয়ের রোজগেরে মানুষ এই সেমাই কিনত। ধনী, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বনেদী পরিবার এই সেমাইয়ের ধারে কাছেও যেত না। বলা হতো এগুলো গরিবের সেমাই। রমজান শেষে ঈদ-উল-ফিতর অনেক এলাকায় আজো সেমাইয়ের ঈদ নামে পরিচিত।

women

আশির দশকের মধ্যভাগে এই চিকন সেমাই পথের ধার থেকে শহরের বাজারে দুই একটি দোকানে উঠতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগেই হাতে বানানো এই সেমাইয়ের ম্যানুয়াল যন্ত্র আবিষ্কার করেন বগুড়ার এক তরুণ। তারপর শহরতলীর বিভিন্ন স্থানে এই যন্ত্র স্থাপিত হয়ে বাণিজ্যিকভাবে সেমাই বানানো শুরু হয়।

সেমাইপল্লীর মহাজন আব্দুল করিম জাগো নিউজকে জানান, প্রতিদিন এ পল্লী থেকে এক হাজারেরও বেশি খাঁচা (২৫ কেজি করে) বগুড়া শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। বাজারে পাইকারি প্রতি কেজি ৫০ টাকা। সেই হিসেবে এক খাঁচা সেমাইয়ের দাম পড়ে ১২৫০ টাকা। আর এক হাজার খাঁচার দাম সাড়ে ১২ লাখ টাকা। রোজার আগে থেকেই চিকন সেমাইয়ের মৌসুম শুরু হয়। আগে পরে মিলে তিন মাস চলে সেমাই বিক্রি। এক মৌসুমে সব মিলিয়ে বিক্রি হয় কয়েক কোটি টাকার সেমাই।

শ্যাওলাগাতি এলাকার সেমাইকল মালিক আবদুর রশিদ জানান, সেমাই তৈরির জন্য প্রতিদিন ভোর থেকে কারিগররা এসে কাজ শুরু করেন। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে দিনে ২-৩ ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। আর বৃষ্টির কারণে উৎপাদিত সেমাই রোদে শুকানোও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে উৎপাদন কিছুটা কমেছে।

বেশ কয়েকজন নারী কারিগর জানান, সেমাই তৈরির কারখানাগুলোতে পুরুষের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক কাজ করে থাকেন। তবে বেশির ভাগ নারীরা সাধারণত রমজান মাস এলে এ পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। দিনে তারা প্রায় ২৫০ টাকা পারিশ্রমিক পান। এতে করে তাদের সাংসারিক আয় বেড়ে যায়।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে এই সেমাই এখন খুচরা বিক্রির পাশাপাশি বাহারি প্যাকেটজাত হয়েছে। রান্নার সুবিধার জন্য সেমাই ভেজে প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। তবে তার দাম কিছুটা বেশি পড়ে। বর্তমানে নানা ধরনের চিকন সেমাই মিলছে বাজারে। দাম মান অনুযায়ী প্রতি কেজি ৬০ টাকা থেকে ঊর্ধ্বে ১০০ টাকা পর্যন্ত। চিকন ভাজা সেমাই ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। দাম বেশি কেন এমন প্রশ্নে এক দোকানি বলেন, রান্নার খাটুনিতো অনেকটা কমে গেছে। রেডি নুডলসের মতো কড়াইয়ে ছেড়ে দিলেই সেমাই খাবার জন্য তৈরি হয়ে যাবে। এবার প্রতিকেজি চিকন সাদা সেমাই পাইকারি ৫০-৫৫ টাকা ও প্যাকেটজাত করে খোলা বাজারে ৮০-৯০ টাকা হিসেবে বেচাকেনা হচ্ছে।

বগুড়ার ব্যবসায়ী মকবুল হোসের তরফদার জাগো নিউজকে বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সেমাই রফতানির তালিকা এখনো নেই। দুই দেশের মধ্যে রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণে বগুড়ার চিকন সেমাই ও দই অন্তর্ভুক্ত করলে উভয় দেশই লাভবান হবে। তবে এখন বিকল্প উপায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বগুড়ার চিকন সেমাই যাচ্ছে।

লিমন বাসার/এমজেড/আরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।