রোহিঙ্গা গণহত্যায় কি সু চি অভিযুক্ত হতে পারেন?
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অপরাধের সঙ্গে জড়িত হোতারা বিচারের মুখোমুখি হবেন বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ জেইদ রা’দ আল হুসেইন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক ওয়াচডগ সংস্থার প্রধান তিনি; তার এ মতামতের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এতে শীর্ষ নেতারাও অভিযুক্ত হতে পারেন- মিয়ানমারের বেসামরিক নেতা অং সান সু চি ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল অং মিন হ্লেইংও ভবিষ্যতে কোনো সময়ে নিজেদেরকে গণহত্যার অভিযোগের মধ্যে খুঁজে পেতে পারেন; এই সম্ভাবনা নাকচ করে দেননি রেইদও।
চলতি মাসের শুরুতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক পরিষদে জেইদ রা’দ আল হুসেইন বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক এবং পরিকল্পিত নিপীড়নের ধরন দেখে এটিকে গণহত্যা না বলে পারা যায় না।
জেনেভায় জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ে তিনি বলেন, সামরিক অভিযানের পরিসরে এটি পরিষ্কার যে, উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
গণহত্যা এমন একটি শব্দ যে সম্পর্কে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক হয়। এটি ভয়াবহ- তথাকথিত ‘অপরাধেরও অপরাধ’। খুব কম মানুষই এই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। হলোকাস্টের পর এই অপরাধের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনেকেই একটি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেন। এতে বলা হয়, গণহত্যা হচ্ছে- একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্দেশ্যে সংঘটিত অপরাধ।
গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে কি না তা প্রমাণ করা জেইদ রা’দ আল হুসেনের কাজ নয়- শুধুমাত্র আদালতই এটি করতে পারেন। তবে তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‘ভয়াবহ নিষ্ঠুর হামলায়’ দায়ী হোতাদের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে এই কাজ যে অত্যন্ত কঠিন হবে সেটিও স্বীকার করেছেন তিনি। ‘মূল কারণ হলো, আপনি যখন গণহত্যা সংঘটনের পরিকল্পনা করবেন; তখন আপনি এটি কাগজে-কলমে করবেন না এবং আপনি দিক নির্দেশনাও দেবেন না।’
তিনি বলেন, ‘বিচার শুরুর জন্য যথেষ্ঠ প্রমাণ আছে। তবে আমরা যা দেখেছি তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে কোনো একটি আদালত যদি গণহত্যার অভিযোগ গঠন করেন, তাহলে এতে আমি আশ্চর্যান্বিত হবো না।’
ডিসেম্বরের শুরুতে রাখাইনের মোট জনগোষ্ঠীর দুই তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়েছেন। গত আগস্টের শেষের দিকে সেনাবাহিনী ব্যাপক অভিযান শুরু করে। শত শত গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিবিসির দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধি জোনাথন রওলাত এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ভয়াবহ নিধনযজ্ঞে সু চি ও সেনাপ্রধান হ্লেইং ভবিষ্যতে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন কি না সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, সেখানে ভয়াবহ নিপীড়নের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে : সঙ্কটের শুরুর দিকে আমি যখন শরণার্থী শিবিরগুলো সফরে গিয়েছিলাম তখন গণহত্যা, খুন ও গণধর্ষণের অনেক অভিযোগ শুনেছি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধানকে এসব ঘটনা নাড়া দিয়েছে। তিনি সহিংসতা শুরুর ছয় মাস আগেই রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চির প্রতি আহ্বান জানান।
জেইদ রা’দ আল হুসেইন টেলিফোনে সু চির সঙ্গে গত ফেব্রুয়ারিতে কথা বলেন। এই সময় তার (রা’দ) কার্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি নথিতে গত বছরের অক্টাবরের শুরু থেকে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর রাখাইনে নৃশংস অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে বলে তুলে ধরা হয়।
জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এই সামরিক অভিযান বন্ধ করতে আমি তাকে আহ্বান জানিয়েছিলাম। মানবিক জায়গা থেকে অভিযান বন্ধ করতে কিছু একটা করার জন্য আমি তাকে আহ্বান জানিয়েছিলাম...এটি আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের যে তিনি কোনো পদক্ষেপই নেননি।’
সেনাবাহিনীর ওপর সু চির ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত, তবে জেইদ রা’দ আল হুসেইনের বিশ্বাস, তিনি চেষ্টা করলে কিছু করতে পারবেন এবং সেনা অভিযান থামাতে পারেন। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি সু চির সমালোচনা করেন। ‘তাদের নাম ধরে না ডাকাটা অমানবিক কাজ; যেখানে আপনি বিশ্বাস রাখতে শুরু করেছিলেন যে কোনো কিছুই সম্ভব।’
জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনি মনে করেন ২০১৬ সালের সহিংসতার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় তারা উৎসাহ পেয়েছে। আমি মনে করি, তারা সেই সময়ে উপসংহারে পৌঁছানোর ছক এঁকেছিল যে, কোনো ধরনের ভয় ছাড়াই তাদের অভিযান চলবে।’
‘আমরা বুঝেছি, এটি বেশ চিন্তা-ভাবনা এবং পরিকল্পনা করেই হাতে নেয়া হয়েছিল।’ মিয়ানমার সরকার বলছে, গত ২৫ আগস্ট সন্ত্রাসী হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য নিহতের জবাব দিতে তারা সামরিক অভিযান শুরু করেছে। বিবিসির প্যানোরোমা অনুষ্ঠানের কর্মীরা প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন যে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান এ অভিযানের পূর্ব-প্রস্তুতি তারও আগে থেকে নেয়া শুরু হয়েছিল।
বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি জোনাথন রওলাত বলেন, আমরা দেখিছি মিয়ানমার সরকার স্থানীয় বৌদ্ধদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। গত বছরের সহিংসতার পর মিয়ানমার সরকার একটি প্রস্তাব দেয় : ‘রাজ্য রক্ষা করতে প্রস্তুত এমন রাখাইন জাতীয়তাবাদীদের জন্য স্থানীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে।’
মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথিউ স্মিথ বলেন, ‘বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধ চালানোর জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। চলতি বছরের রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অভিযানের তদন্ত করছে এ সংস্থাটি।
রোহিঙ্গাদের আরো বিভিন্ন উপায়ে ঝুঁকিতে ফেলা হয়। উত্তর রাখাইনে গ্রীষ্মকালে ব্যাপক খাদ্য সঙ্কট শুরু হয় এবং সরকার ব্যাপক কঠোর তল্লাশি শুরু করে। বিবিসির প্যানারোমা বলছে, মধ্য আগস্টেই উত্তর রাখাইনে সব ধরনের খাবারের সরবরাহ ও সহায়তা বন্ধ করে দেয়া হয়।
অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করা হয়। সন্ত্রাসী হামলার দুই সপ্তাহ আগে, ১০ আগস্ট রাখাইনে এক ব্যাটালিয়ন সেনাসদস্যকে মোতায়েনের খবর পাওয়া যায়। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক মিয়ানমারের প্রতিনিধি ওই সময় ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি জনসতর্কতা জারি করেন এবং মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানান।
কিন্তু গত ২৫ আগস্ট যখন রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা ৩০টি পুলিশি ও একটি সেনা চৌকিতে হামলা চালায় তখন সেনাবাহিনী অত্যন্ত কঠোর, পরিকল্পিত ও ধ্বংসাত্মক উপায়ে জবাব দেয়া শুরু করে। এই অভিযানের ব্যাপারে অং সান সু চি ও সেনাবাহিনীর প্রধান হ্লেইংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবিসি। কিন্তু তারা উভয়ই এ বিষয়ে কোনো জবাব দেননি।
হামলার চার মাস পেরিয়ে গেলেও সেখানে এখনো সহিংসতার ঘটনা ঘটছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন জেইদ রা’দ আল হুসেইন। জাতিসংঘের এই কর্মকর্তার শঙ্কা, সেখানে যে আরো ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে, তার মুখোশ উন্মোচনের নমুনা হতে পারে এটি।
বাংলাদেশের বিশাল শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া এই রোহিঙ্গা জিহাদী গোষ্ঠী গঠন করে মিয়ানমারে হামলা চালাতে পারেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এমনকি এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য হতে পারে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোও। এটি বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মাঝে সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা ভয়াবহ এই পরিণতির কথা স্বীকার করলেও মিয়ানমার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছে না বলে তার বিশ্বাস।
এসআইএস/জেআইএম