হিজড়ার সংজ্ঞায়নে বাংলাদেশ হবে অগ্রপথিক
‘আমরা পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি, অস্বীকার করিনা। কিন্তু ছেলেদের মতো চলাফেরা করতে, ওদের মতো প্যান্ট শার্ট পরতে কিংবা ওদের মতো দলবেঁধে খেলাধুলা করতে মন চায়না, একদম ভাল লাগেনা। মেয়েদের মত শাড়ি পরতে ও সুন্দর করে সাজগোজ করে ঘুরে বেড়াতে অনেক বেশি ভাল লাগে। আবার মেয়েদের সান্নিধ্য পছন্দ নয়, মন শুধু পুরুষের সান্নিধ্য পেতে চায়। ম্যাডাম আপনি বলতে পারেন কেন এমন হয়? ডাক্তারি পরীক্ষায় পুরুষ বা নারী যাই ঘোষণা করুক না কেন আমরা হিজড়া হিসেবেই স্বীকৃতি পেতে চাই।’
সম্প্রতি সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক পারভীন মেহতাবের সামনে দাঁড়িয়ে ছন্দা (ছদ্মনাম) নামের একজন হিজড়া এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। বুধবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে পারভীন মেহতাব বলেন, ছন্দার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠে। সমাজসেবা অধিদফতরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১২টি পদে চূড়ান্তভাবে মনোনীত ১২ জন কথিত হিজড়াকে আমিই পুরুষ সন্দেহ করে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ওর প্রশ্ন শুনে অনুধাবন করছি সত্যিই তো, কেন তাদের সঙ্গে এমনটি হচ্ছে, কোথাও যেন কী ভুল হচ্ছে
সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাতেই তারা শারিরীক ও মানসিকভাবে এমন কিছু দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে যাতে তারা পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও মেয়ে সেজে থাকতে পছন্দ করছে। শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, গোটা বিশ্বে তৃতীয় লিঙ্গ হিজড়ার সংজ্ঞা নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
তিনি জানান, গোটা বিশ্বের তৃতীয় লিঙ্গের পাশে দাঁড়াতে সমাজসেবা অধিদফতরই হিজড়াদের প্রকৃত সংজ্ঞা নির্ধারণে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। ঈদুল ফিতরের পর বিভিন্ন হিজড়া সংগঠন, ডাক্তার, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, আইনবিদ, মানবাধিকার সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হবে। সকলের মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় লিঙ্গের সংজ্ঞা নির্ধারিত হবে।
তিনি বলেন, আসলে হিজড়াদের নিয়ে কেউ ভাল করে ভাবেনি। সারা পৃথিবীতে তৃতীয় লিঙ্গ হাজার হাজার হিজড়া থাকলেও এর সার্বজনীন কোন সংজ্ঞা এখনো নির্ধারণ হয়নি। তাই বাংলাদেশের ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনে ১২ হিজড়া পুরুষ বলে চিহ্নিত হওয়ার পর হিজড়ার সংজ্ঞা কী হবে তা নিয়ে গোটা পৃথিবীতে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
পারভীন মেহতাব বলেন- এএফপি, বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তজার্তিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের এ ঘটনা নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা, ইউরোপ, লন্ডনসহ উন্নত বিশ্বে হিজড়াদের নিয়ে কাজ করেন এমন কোন সংগঠন থেকে হিজড়ার সংজ্ঞা নিয়ে এখনো পর্যন্ত ওই ১২ কথিত হিজড়ার পাশে দাঁড়ায়নি। তার মানে তারাও হিজড়ার সঠিক সংজ্ঞা জানেনা।
সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে- হিজড়ার সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়ায় কথিত ওই ১২ হিজড়ার নিয়োগ স্থগিত করা হয়েছে। বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ বন্ধ থাকবে।
এ খবরে চূড়ান্তভাবে মনোনীত ১২ কথিত হিজড়া মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। তারা বিভিন্ন হিজড়া সংগঠনের নেতাদের কাছে বিষয়টি নিয়ে তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, ডাক্তারি পরীক্ষায় পুরুষ চিহ্নিত করে তাদের নিয়োগ দেয়ার পথ বন্ধ করা হবে জানলে তারা পরীক্ষার জন্য যেতেননা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও লিঙ্গ নির্ধারণে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কাছে শারিরিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তাই মানসিক বা অন্য কোন উপায়ে তারা হিজড়া কিনা তা আমরা বলতে পারবোনা।
পরীক্ষায় তাদের আর দশটা পুরুষের মতো তাদের লিঙ্গ, অণ্ডকোষ, শুক্রথলি পাওয়া যায়। চুলের গড়ন, বুকে, হাতে ও পায়ে লোম থাকার আলামত পাওয়া গেছে।
লাইট হাউজের (হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠন) নির্বাহী পরিচালক মো.হারুন-ওর-রশীদ এর কাছে হিজড়ার সংজ্ঞা জানতে চাইলে বলেন, সত্যি কথা বলতে হিজড়াদের সার্বজনীন কোন সংজ্ঞা নেই। সামাজিকভাবে যারা নিজেদের হিজড়া বলে দাবি করে সমাজ তাদের এই পরিচয় মেনে নিলে তাকে আমরা হিজড়া বলে সংজ্ঞায়িত করি। তার চলাফেরা, কথাবার্তা ও সাজ সজ্জা মেয়েদের মতো হয়। তবে বৈজ্ঞানিকভাবে সংজ্ঞায়নের বিষয়টি ভিন্ন হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. হেলালউদ্দিন আহমেদ বলেন, হিজড়ারা সামাজিকভাবে চরম অবহেলিত। তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ করে দিতে সম্মিলিতভাবে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে তার আগে নিশ্চিতভাবে সংজ্ঞায়িত হওয়াটা খুব জরুরি বলে তিনি মন্তব্য করেন।
## হিজড়াদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণে জরিপ করবে পরিসংখ্যান ব্যুরো
এমইউ/এসএইচএস/আরআই