আরো ভাল হতে পারতো টাইমিং


প্রকাশিত: ০৬:২১ এএম, ০৭ জুলাই ২০১৫

ক্রিকেটে টাইমিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবং বহুল ব্যবহৃত শব্দ। বাইশ গজে টাইমিং ঠিকঠাক না হলে বড় ব্যাটসম্যানও উইকেট হারাতে পারেন। তা সেই ব্যাটসম্যানের নাম স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস, শচীন টেন্ডুলকার কিংবা ব্রায়ান লারা যাই হোক না কেন। টাইমিং শুধু বাইশ গজে নয়, তার বাইরেও খুব বড় একটা ফ্যাক্টর। সেটা মানুষের জীবনে হোক। কিংবা তার কর্মে হোক। আর ক্রিকেট তো মানুষের জীবন কিংবা কর্মের বাইরে কিছু নয়। টি-টোয়েন্টি নামক ক্রিকেটের উদ্ভাবনে যারা মস্তিষ্ক খরচ করেছেন তাদের কাছেও টাইমিংটা খুব বড় ব্যাপার ছিল।

পাঁচ দিন ধরে টেস্ট ক্রিকেট স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট এর এই জেটযুগে কর্মব্যস্ত মানুষের কাছে বোরিং হয়ে আসছিল। ওয়ানডে ক্রিকেটের উন্মাদনায় একটু ভাটার টান। ঠিক সেই সময় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের উদ্ভাবন। ইনসট্যান্ট কফির মতো ইনসট্যান্ট ক্রিকেটীয় উন্নাদনা উপভোগের জন্য ক্রিকেটের এই ক্ষুদ্র সংস্করণ-ই তুলনামূলকভাবে ভাল মনে হলো ক্রিকেট মহলে। কারণ, সময় সাশ্রয়। আবার অধিক আয়। ক্রিকেট বাণিজ্যের জন্যও ভাল উপাদান। ক্রিকেট বিশ্ব তাই লুফে নিয়েছিল ক্রিকেটের আধুনিকতম এই সংস্কারকে। টি-টোয়েন্টির জনপ্রিয়তার পেছনে আরো একটা কারণ হচ্ছে কর্মক্লান্ত মানুষগুলো অফিসের একঘেয়েমি মুঁছে ফেলতে অফিস শেষে ঘন্টা তিনেক সময় ক্রিকেট মাঠে কাটিয়ে যেতে পারেন। সেখান থেকে খুঁজে নিতে পারেন পরের দিনের জন্য বাড়তি অক্সিজেন। যে কারণে এই ফরম্যাটের ক্রিকেটের জন্য সন্ধ্যাকেই বেছে নেয়া হলো। রঙিন পোশাকে, সাদা বলে এটা মূলত নৈশ ক্রিকেট।

সব মিলিয়ে এই ফরম্যাটটা জনপ্রিয়তা পেলো। বাণিজ্যিক সাফল্যও পেলো খুব দ্রুততম সময়ে। বাণিজ্যিক সাফল্য এবং জনপ্রিয়তার  মাপকাঠিতে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে যখন ক্রিকেট  ঠিক ফুটবল, রাগবি, টেনিস, বাস্কেটবলের মতো খেলার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এঁটে উঠতে পারছিল না, সেই সময় টি-টোয়েন্টি এক ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতও দিলো। সেই বিপ্লবের পথ ধরে টেস্ট ক্রিকেটকেও রাতের যাত্রী বানানোর পরিকল্পনা হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে হয়তো এবছরই অ্যাডিলেডে ‘ঐতিহাসিক দিন-রাতের টেস্ট’-এ মুখোমুখি হবে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। রাতের টেস্টের জন্য লাল বলের পরিবর্তে কুকাবুরা তৈরি করছে গোলাপি বল। সব মিলিয়ে দিন-রাতের টেস্ট যদি সাফল্যের মুখ দেখে ফেলে, তাহলে বিশুদ্ধবাদিরা যতোই গেলো গেলো বলে চিৎকার কারুক না কেন, হয়তো আগামী দিনের টেস্ট ক্রিকেট লাল বলের পরিবর্তে গোলাপি বলেই হবে। টেস্ট নামক খেলাটার ধরন- ধারণেও আসবে পরিবর্তন। এই সব পরিবর্তনের মূল কারণ, দর্শক চাহিদা। দর্শকদের সময়ের কথাটা মাথায় রেখেই এই সব বিবর্তনের চিন্তা হচ্ছে।

টেস্ট ক্রিকেট মানে শ্বেতশুভ্র একটা ব্যাপার। আভিজাত্যের ছোঁয়া যেন শুধু টেস্ট ক্রিকেটে! সেটা শুধু মাঠে নয়। মাঠের বাইরে দর্শকদের মনের মধ্যেও সেরকম একটা ভাব! বাদাম চিবুতে চিবুতে গ্যালারিতে বসে টেস্ট ক্রিকেট দেখবো। মাঝে মধ্যে খুব ভাল একটা কেতাবি শট দেখবো। মনে মনে পুলকিত হবো। বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা শট দেখে এমনভাবে হাততালি দেবো যাতে এক হাত অন্য হাতের স্পর্শ টের পাবে না! টেস্টেও সেইদিনটা এখন অতীত হতে চলেছে। ক্রিকেটাররা অনেক বেশি আগ্রাসী ক্রিকেট খেলছেন। যুগের সাথে তাল মেলাতে চেষ্টা করছেন। তারপরও ক্রিকেট কর্তারা সেটাকে যথেষ্ট মনে করছেন না, অন্যান্য খেলার সাথে টিকে থাকার ব্যাপারে। তাই প্রতিনিয়ত নতুন  কিছু চিন্তা করা হচ্ছে। কিন্তু সেই নতুন চিন্তার সঙ্গে কি আমরা তাল মেলাতে পারছি?

মনে হয় পারছি না। পারলে কি সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ দুপুর একটায় শুরু হতো! রাতের আলোর পরিবর্তে কেন ভরদুপুরে টি-টোয়েন্টি! এই প্রশ্নের উত্তরে  ক্রিকেট কর্তারা বলছেন, রোজার কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত! আর একটু ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হচ্ছে, দর্শকরা যাতে ঠিকঠাক মতো বাসায় গিয়ে ইফতারি করতে পারেন সেটা বিবেচনায় এনে দুপুর একটায় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ শুরু করা হয়েছে। সোয়া চারটার মধ্যে খেলা শেষ হচ্ছে। দর্শকরা নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে ইফতারি করতে পারছেন। হয়তো পারছেন। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ম্যাচ তো ইফতারি শেষে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় কিংবা রাত আটটায় শুরুই করা যেতো। যাতে দর্শকরা আরো নিশ্চিন্ত মনে খুব প্রশান্তি নিয়ে মাঠে এসে খেলা দেখতে পারতেন। তাতে মাঠে দর্শক সংখ্যাও বেশি হতো। আবার খোদ বোর্ডের প্রধান নির্বাহী বলেছেন; টিম ম্যানেজমেন্ট এবং ক্রিকেট অপারেশনস কমিটির সাথে আলোচনা করেই ম্যাচের টাইম ঠিক করা হয়েছে।  তাহলে কি সাউথ আফ্রিকাকে বিপাকে ফেলতে ভরদুপুরে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ করার চিন্তা-ভাবনা ছিল! আবার ইফতারির কথা মাথায় রেখে যদি দুপুরে টি-টোয়েন্টি ম্যাচ আয়োজন করা হয়, তাহলে ওয়ানডে ক্রিকেটের টাইমিংটা দুপুর ১২টায় কেন? ওয়ানডে সিরিজে ম্যাচের সময়ই তো ইফতারি। সেখানে কি দর্শকদের কথা খুব একটা চিন্তা করা হলো?

বেশি সংখ্যক দর্শক খেলাটা দেখার যাতে সুযোগ পায়, সেটা মাথায় রাখা উচিত। সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজে টেলিভিশনের মাধ্যমে সেই দেশের দর্শকরাও যাতে খেলাটা সরাসরি দেখতে পান, তাদের বিষয়টাও গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল।  কিন্তু টি-টোয়েন্টি সিরিজে সাউথ আফ্রিকা যখন বাংলাদেশের মুখোমুখি হচ্ছে তখন জোহান্সেবার্গ-ডারবান-কেপটাউন-পোর্টএলিজাবেথের মানুষগুলোর চোখে ঘুম জাড়ানো। টেলিভিশনের পর্দায়  ক্রিকেট দেখতে চোখ রাখবেন কি তারা! আবার ম্যাচগুলো যদি বাংলাদেশ সময় রাত আটটায় শুরু হতো তাহলে এদেশের মানুষ যেমন বাসায় ইফতারি করে মাঠে খেলা দেখতে আসতে পারতেন কিংবা টেলিভিশনের সামনে বসতে পারতেন, একইভাবে সাউথ আফ্রিকার অফিস ফেরত মানুষগুলোও টেলিভিশনের সামনে বসতে পারতেন ক্রিকেট নামক খেলাটা দেখার জন্য। ম্যাচ আয়োজনের টাইমিংটা ঠিক হলো কি না বাংলাদেশ ক্রিকেট কর্তারা  একটু ভাবতে পারেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনজুরি টাইম’ ‘এক্সট্রা টাইম’ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কাজ করেছেন দেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে, টেলিভিশন এবং দেশি-বিদেশি রেডিওতে।

এইচআর/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।