ইয়েমেন : গৃহযুদ্ধ থেকে প্রেসিডেন্ট সালেহর মৃত্যু

সাইফুজ্জামান সুমন
সাইফুজ্জামান সুমন সাইফুজ্জামান সুমন , সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৪৪ পিএম, ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭

২০১১ সালে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যখন ব্যাপক গণজাগরণ শুরু হয়; তখন আরব বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ইয়েমেনের নাগরিকরা তিন দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আলী আব্দুল্লাহ সালেহর বিরুদ্ধে গণ-বিক্ষোভের ডাক দেন।

ক্ষমতার ৩৩ বছরে ১৯৭৮ সালে তিনি তৎকালীন উত্তর ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হন এবং ১৯৯০ সালে বিভক্ত ইয়েমেনের পুনরেকত্রীকরণের পরও দেশটির নেতৃত্ব দেন তিনি। সালেহর দীর্ঘদিনের শাসনামলে অনেকে মনে করেন, তিনি শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্যই কাজ করছেন। ২০১১ সালে ইয়েমেনের শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তনের দাবি জোরালো হয়।

দারিদ্রতা ও বেকারত্বের হার বাড়তে থাকায় ২০১১ সালের প্রথম দুই মাস জুড়ে ইয়েমেনের রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভ করেন। কয়েক সপ্তাহ যেতেই বিক্ষোভে উত্তাল ইয়েমেনে প্রেসিডেন্ট সালেহর অপসারণের দাবি উঠে। দেশটির অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে সালেহর ব্যর্থতার অভিযোগ করেন বিক্ষোভকারীরা।

saleh-yemen

ইয়েমেনের অর্থনীতির জন্য উত্থাল-পাতাল সময় ছিল তখন। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, বাড়ছে বেকারত্ব। ২০১৫ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তেল রফতানি থেকে আসা দেশটির অর্থ নষ্ট হচ্ছে অথবা লুটপাট চলছে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি এবং জালিয়াতি থেকে প্রেসিডেন্ট সালেহ অন্তত ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিশাল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশিদের সহায়তার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

সানার প্রতিবাদ

২০১১ সালের শুরুর দিকে দেশটির হাজার হাজার শিক্ষার্থী সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। রাজধানী সানা থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন এডেন, তায়াজসহ অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। সরকারবিরোধী এই আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর দমন অভিযান শুরু হয়; যাতে প্রাণ যায় কমপক্ষে ৫০ জনের।

প্রাণহানির এ ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক নিন্দার ঝড় ওঠে। সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও উচ্চ-পদস্থ সেনাকর্মকর্তা গণপদত্যাগ করেন। ওই বছর দেশটির বিরোধী গোষ্ঠীগুলো প্রেসিডেন্ট সালেহকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তাব দিলেও তা নাকচ করেন তিনি। একই সঙ্গে মার্চে পদত্যাগ করার পরিকল্পনা করছেন বলেও ইঙ্গিত দেন সালেহ।

saleh-yemen

একমাস পর নিজের এই অবস্থান থেকে সরে আসেন তিনি। তাকে নিরাপত্তা, দায়মুক্তি দিতে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) এক সহায়তা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ওই চুক্তিতে দেশটির বিরোধীদলগুলোর সঙ্গে তার রাজনৈতিক দলের একটি জোট গঠনের কথা ছিল।

বিতর্ক ও সমালোচনার পর যখন দেশটির বিরোধী গোষ্ঠীগুলো চুক্তিতে রাজি হয়; সালেহ তখন ভিন্ন ভিন্ন তিনটি কারণে চুক্তিতে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকেন; ঘোর-বিশৃঙ্খলা শুরু হয় মূলত এই সময়।

ব্যর্থ রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন

বিক্ষোভের মুখে জিসিসির চুক্তি অনুযায়ী অবশেষে দুই বছরের জন্য তার সহযোগী আব্দেরাব্বু মানসুর আল-হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন সালেহ। তবে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে দেশটিতে ব্যাপক বেকারত্ব, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং দক্ষিণে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করে।

২০১২ সালের শুরুর দিকে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাদি একমাত্র প্রার্থী হিসেবে হাজির হন; যা শিয়া হুথি, বিচ্ছিন্নতাবাদী সাউদার্ন ম্যুভমেন্টসহ অন্যান্য বিরোধী গোষ্ঠীগুলো বর্জন করে। গণভোটে দেশটির ৬৯ শতাংশ ভোটার ভোটদান করেন; প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন হাদি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হাদি নেতৃত্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়।

saleh-yemen

নতুন প্রেসিডেন্ট তার কর্তৃত্ব বাস্তবায়নের লড়াই শুরু করেন। হুথি বিদ্রোহী ও সালেহর সমর্থকদের সমন্বয়ে একটি নতুন জোট গঠন করা হয়। এই জোট হাদির অনুগত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০১৫ সালের শুরুতে বিদ্রোহীরা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা চালায়; এমনকি প্রেসিডেন্ট হাদিকে সেই সময় দেশ থেকে পালিয়ে সৌদি আরবে পাড়ি জমাতে বাধ্য করে। যেখানে তিনি এখন পর্যন্ত স্বেচ্ছা-নির্বাসনে আছেন।

সৌদি-নেতৃত্বাধীন জোট

হুথি বিদ্রোহীদের বড় ধরনের হুমকি ও ইরানের প্রতিনিধি মনে করে সৌদি আরব। সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা লাগিয়ে দেয় হুথিদের বিরুদ্ধে। রিয়াদের শঙ্কা; সৌদি সীমান্তে ইরানকে পদচিহ্ন রাখার সুযোগ করে দিতে পারে ইয়েমেনের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী। তবে হুথিদের সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে ইরান; কিন্তু এরপরও হুথিদের দমনে ১০ দেশের সামরিক জোট গঠন থেকে বিরত থাকেনি সৌদি আরব।

২০১৫ সালের মার্চে অপারেশন ডিসিসিভ স্টর্ম নামে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ও হাদির সরকারকে ফের ক্ষমতায় বসানোর লক্ষ্যে এই হামলা শুরু করা হয় বলে জানায় সৌদি জোট। দেশের উত্তরাঞ্চলে সামরিক অভিযান শুরু হলেও তা ব্যর্থ হয়। তবে সানার নিয়ন্ত্রণ হারায় হুথি বিদ্রোহীরা।

saleh-yemen

সৌদি নেতৃত্বাধীন এই সামরিক জোটে কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, মরক্কো, সেনেগাল ও সুদান অংশ নেয়। চলতি বছরের জুনে কাতারের সঙ্গে স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথ অবরোধের পর জোট থেকে দেশটিকে বহিষ্কার করা হয়। ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের সমর্থন ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন অভিযোগ আনা হয় কাতারের বিরুদ্ধে।

বৃহত্তম মানবিক সংকট

সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের ৩৩ মাসের বিমান, সমুদ্র ও স্থল অভিযানে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে ইয়েমেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা ও আহত মানুষের আর্তনাদ ও রোগের মহামারিতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানবিক সংকট শুরু হয়েছে দেশটিতে। জাতিসংঘ বলছে, ইয়েমেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ৭০ লাখ ইয়েমেনি দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়েছেন। দেশটির এক কোটি ৮৮ লাখ মানুষের দৈনন্দিন সহায়তা প্রয়োজন। ওষুধ ও জ্বালানির ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে। রান্নার গ্যাসের মূল্য ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস বলছে, ২৫ লাখ মানুষ বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে ভুগছেন। এছাড়া প্রত্যেক ১২ জনে একজন মারাত্মক পুষ্টিহীন। প্রায় ৩৩ লাখ মানুষ যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গৃহহীন হয়ে পড়েছে। সোমবার হুথি বিদ্রোহীদের গুলিতে ইয়েমেনের দীর্ঘদিনের ও প্রভাবশালী শাসক সালেহ যুগের অবসান ঘটেছে। উপজাতিদের মধ্যস্থতায় রাজধানী সানার বাড়ি ছেড়ে দক্ষিণের সিনহান জেলায় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য হুথি বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি সমঝোতা হয়েছিল সালেহর। বিদ্রোহীরা সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে নিরাপদে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। তার গাড়িবহরে কোনো হামলা চালানো হবে না বলেও জানানো হয়।

saleh-yemen

সালেহ তার ছেলে ও রাজনৈতিক দল জেনারেল পিপলস কংগ্রেস পার্টির জ্যেষ্ঠ দুই সদস্যকে নিয়ে একটি গাড়িতে করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। সিনহান জেলার বৈয়ত আল-আহমার গ্রাম থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের সায়ান এলাকায় সালেহর গাড়ি পৌঁছায়। পরে ওই এলাকার সড়কে হুথি বিদ্রোহীদের সাতটি গাড়ি সড়ক অবরোধ করে তাদের আটক করে।

আল-আরাবিয়া বলছে, হুথি বিদ্রোহীদের সাতটি গাড়ি সড়ক পুরোপুরি অবরোধ করে রাখায় সালেহকে বহনকারী গাড়িটি পালিয়ে যেতে পারেনি। পরে হুথি বিদ্রোহীরা সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ও তার সহযোগীদের গাড়ি থেকে বের করে আনে। রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সালেহর পেট ও মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালায় তারা। বেশ কয়েকটি সূত্র বলছে, কমপক্ষে ৩৫ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সালেহর মৃত্যুর জেরে ইয়েমেনে রাজনৈতিক অচলাবস্থা শুরু হবে। সালেহর মৃত্যুতে দেশটিতে বড় ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট দেখা দিতে পারে।

হুথি বিদ্রোহীদের হামলায় সালেহর মৃত্যুর পর বিশ্লেষক অ্যাডাম ব্যারন আল-জাজিরাকে বলেন, আমরা আজ যে ইয়েমেন দেখছি; সেটি গতকালের ইয়েমেন নয়। আবার আজ যে ইয়েমেন দেখা যাচ্ছে আগামীকাল সেই ইয়েমেন দেখা যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

এসআইএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।