ঢাকার রাস্তায় নদী


প্রকাশিত: ০৬:৪১ এএম, ২৮ জুন ২০১৫

রুমি স্কুল থেকে ফিরেই বললো, বাবা বাবা বলো তো এখন বাংলা কী মাস? বাবা যতই বলে আষাঢ়, রুমি ততই বলে বৈশাখ। বাবা বলে আষাঢ় বলেই তো এখন এতো বৃষ্টি হচ্ছে। রুমি বলে তা ঠিক আছে। কিন্তু বাইরে যে নদী হচ্ছে সেটা বৈশাখের। বাবার চক্ষু চড়কগাছ। নদী হচ্ছে কোথায়?

কেন পড়নি, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে। পার হয়ে যায় গরু, অবশ্য ঢাকায় গরু নেই। কিন্তু গাড়ি আছে অনেক। একটা গাড়ি ভোঁ করে চলে যাওয়ার সময়, দেখো না আমার জামা কেমন ভিজিয়ে দিয়েছে। হাঁটুজল তো অনেক জায়গাতে। ওগুলো সব ছোট ছোট নদী, তাই না বাবা?

বাবার হয়েছে বিপদ। সড়ককে শিশুর চোখে হয়তো নদী বলা যায়। তাতে তাদের কল্পনা শক্তিমত্তার একটা প্রমাণ মেলে। কিন্তু বড়দের জগৎ আলাদা। সেখানে রাজপথ মানে সড়ক। নদী মানে বহতা পানি। সড়কে পানি জমলে শিশু-কল্পনায় তা নদী হতে পারে। সেখানে দুটো রঙিন কাগজের নৌকাও ছেড়ে দেওয়া যায়। কিন্তু বড়দের চোখে তা বড় বেমানান। সে এক ভোগান্তির অভিজ্ঞতার অপর নাম। কয়েকদিন ধরে চলা টানা বর্ষণে এই ভোগান্তিতে এখন রাজধানীবাসী। আবহাওয়াবিদরা বলছেন শনিবারের বৃষ্টি ছিলো মাঝারি ধরনের। একইসঙ্গে তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন এই সময়ে ভারী বর্ষণ একটা স্বাভাবিক ঘটনা। যারা গ্রামে বড় হয়েছেন টানা বর্ষণের অভিজ্ঞতা তাদের আছে। বর্ষাকালে ব্যাঙ-ডাকা সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা কিংবা খিঁচুড়ি খাওয়া লুডু খেলার রোমান্টিক অভিজ্ঞতাও কারো কারো মনে সাঁতার কাটতে পারে। বৃষ্টি ঢাকার জীবনেও এমন সুখ সুখ অনুভূতি এনে দিতে পারতো। স্বস্তি ও উৎসবের একটা উপলক্ষও হতে পারতো। জোসনার পর বৃষ্টি-বিলাস আমাদের জীবনকে অন্যরকম আনন্দে ভাসাতে পারতো। সে সব হয়তো ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো হয়। ঘরে বসে খিঁচুড়ি, ছাদে হেঁটে ভেজা। কিন্তু রাস্তায় নামলেই সেই রোমান্টিকতা শেষ। শুরু হয় দুর্বিষহ ভোগান্তি।

দুই.
বৃষ্টিতে ঢাকাজুড়েই জলাবদ্ধতা হয় এমন নয়। সেনানিবাস এলাকায় বৃষ্টি হয় একটু বেশি। সেখানে জলাবদ্ধতা নেই। পর্যাপ্ত গাছ থাকায় রমনা পার্কের আশপাশেও বৃষ্টি হয় বেশি। ঢাকার অনেক এলাকা থাকে জলাবদ্ধতার বাইরে। তাদের কথা বাদ। বৃষ্টিতে রাজধানীর মতিঝিল, ফকিরাপুল, মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে, রাজারবাগ, শান্তিনগর, রামপুরা, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, কালশী, রূপনগর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মালিবাগ, মৌচাক, তালতলা, খামারবাড়ি ও খিলগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় পানি জমে যায়। বিমানবন্দরের কাছে নিকুঞ্জ-২ আবাসিক এলাকার অনেক রাস্তা হাঁটুপানির নিচে চলে যায়।

যেখানে জলাবদ্ধতা হয়, সেখানে রিকশা উল্টে পড়ে। কারণ অনেক ম্যানহোল মসৃণ রাস্তা থেকে একটু নিচু। এমনিতেই তাতে সিএনজি চালিত অটোরিকশার প্রবল ঝাঁকুনিতে আহত হওয়ার ঘটনা আছে। বৃষ্টির দিনে রিকশা উল্টানো মানে ময়লা পানিতে কাঁকভেজা হওয়া। সে পানির ময়লাগুলো কী কী, সেখানে কী ধরনের ময়লা মিশে তার উদাহরণ না-ই বা দিলাম।

সময় মতো অফিস যেতে না পারা, বসদের বকুনি খাওয়ার আতঙ্ক, সব মিলিয়ে এসব বৃষ্টির দিনে পথচারীদের মনোজগতে যে ঝড় বয়ে যায় তা কালবৈশাখীর চেয়ে কোনোভাবে কম নয়। এসব দিনে সবচেয়ে বড় ভোগান্তি হয়ে আবির্ভূত হয় যানজট। থেমে যায় শহর। সামনে এগুতে চায় না। অথচ মানুষ রাস্তায় নামে কাজে যেতে। কারো অফিস কারো ক্লাস, কারো ব্যবসা, মোট কথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখার তাগিদে মানুষ রাস্তায় নামে। মরিয়া মানুষের বাহন রিকশার ভাড়া বাড়ে হু হু করে। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা নারী ও শিশুদের। ফিটনেসবিহীন গাড়ির ইঞ্জিনবিকল হয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো  ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার এখানে সেখানে। কর্মঘণ্টা এবং জ্বালানির অপচয়ের কথা না ই বা বললাম। তাহলে আমাদের কী বৃষ্টির দরকার নেই?

তিন.
আমরা জানি ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। প্রাকৃতিক বৃষ্টির পানি সে নিম্নযাত্রা ঠেকাতে পারে। এই সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে মাঝারি। হওয়া উচিত ভারী। কিন্তু মাঝারি বৃষ্টির পানি ধারণ করতে পারছে না শহর। নগর বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, খাল দখল, নদী দখল, অপরিকল্পিত নগরায়ণ মানে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্থাপনা বানানোর কুফল জলাবদ্ধতা। ঢাকার জলাবদ্ধতার জন্য উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক কিছু আবাসন প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করেছেন। এছাড়াও তিনি বলেছেন, ১৫ মে’র পরে রাস্তা না কাটার নির্দেশনা ওয়াসা মানছে না। টাকা ছাড়ের হেরফেরের কারণে এমনটি হচ্ছে। খালের মুখ বন্ধ করে দেওয়ায় একটি নামকরা আবাসন প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দেওয়া এবং মিরপুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৬২টি বাড়ি ভাঙার কাজ চলছে বলে জানাচ্ছেন তিনি।

অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরশেনের মেয়র সাঈদ খোকন, জলাবদ্ধতার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ণকে দায়ী করেছেন। তার মতে নগরের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় পয়োব্যবস্থা রাখা হয়নি। তার ওপর বক্স কালভার্ট করে খাল ভরাট করা হয়েছে। নিম্নাঞ্চলের বন্যাপ্রবাহ এলাকায় বালু ফেলে ভরাট করে আবাসন প্রকল্প ও বাড়ি উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের কাছে গেলে আরো অনেক কারণ জানা যাবে। কিন্তু আমাদের জানাই সার, সমাধান আমাদের হাতে নেই। যাদের হাতে আছে তাদেরকে তৎপর হওয়ার তাগিদ দেওয়া ছাড়া আর করার কিছুই নেই।

চার.
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। দেশের সব সুযোগ-সুবিধা এখানে আছে বলে দেশের সব মানুষ জানে। অনেক ক্ষমতাবান ও বিত্তবানের বসবাস এখানে। সংস্কৃতি চর্চারও কেন্দ্র। অথচ, কী দুঃখের বিষয় আমরা নিজেদের বসবাসের শহরটি সুন্দর করে, মার্জিত করে গুছিয়ে রাখতে পারছি না। আমরা কেউ কি আমাদের বসার ঘরটি অগোছালো রাখি? শোয়ার ঘরটি কী এলোমেলো করি রাখি? বড় পরিসরে ভাবলে শহর আমাদের বসারও স্থান, শোয়ারও। সামর্থ্য থাকার পরও আমাদের বিত্তবানরা, ক্ষমতাবানরা শহরকে এলোমেলো রাখবেন এ কি আমরা ভাবতে পারি? নগর বিশেষজ্ঞদের কথার প্রতিধ্বনি করে বলি, এবারের জলাবদ্ধতার জন্য নতুন দুই মেয়রকে কিছুই বলা যাবে না। কিন্তু বছর ঘুরে আবারো আসবে জলাবদ্ধতা। তখন নগরবাসীরা কিন্তু নগরপিতাকে নিয়ে দুয়েক লাইন কথা অবশ্যই বলবে। যদি না তারা দৃশ্যমান কিছু করেন।



এইচআর/বিএ/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।