ব্লু হোয়েলের অস্তিত্ব আদৌও কি আছে?
একজন কিশোর তার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। এক স্কুলছাত্রের হাতে একাধিক ক্ষতচিহ্ন দেখা যায়। এক কলেজছাত্র চলন্ত ট্রেনে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং মারাও যায়। এগুলো খবরের পাতায় হরহামেশা দেখা যায়। এ সব ঘটনা আপাতত নিত্যনৈমত্তিক। কিন্তু ওই তিনটি ঘটনার পেছনে পরিবার থেকে যদি দাবি করা হয় তারা জীবননাশী গেমের কারণে আত্মহত্যা করেছে। নিশ্চয় এই দাবিটি উদ্বেগের।
যদি পরিবার থেকে সন্দেহ করা হয় তারা ব্লু হোয়েল গেমের কারণে মারা গেছেন তাহলে সংবাদজগতের এই শিরোনাম নিশ্চয় জাতীয় পর্যায়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।
ব্লু হোয়েল গেমের এই রহস্যময় ধারণাটি বর্তমানে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন আত্মহত্যার ঘটনায় খোঁজা হচ্ছে ব্লু হোয়েল গেমের সম্পৃক্ততা। কিন্তু আত্মহত্যার এই গল্পগুলোর সঙ্গে ব্লু হোয়েল গেমের সম্পৃক্ততা কতটুকু? আদৌও কি ব্লু হোয়েল গেমের কোনো অস্তিত্ব আছে? আপাতত কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া কঠিন। তবে পুলিশি তদন্ত ও গবেষকদের সিদ্ধান্ত— ব্লু হোয়েলের অস্তিত্ব প্রমাণ করা কঠিন। তারা এ ধরনের গেমের কোনো অস্তিত্ব পাননি।
এখন দেখার বিষয় তারা কেন আত্মহত্যা করে? এর পেছনের কারণটি গেম না মানসিক অসুস্থতা? প্রশ্নের বিষয়-- ব্লু হোয়েলের এই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আগে তারা কি কখনো আত্মহত্যা কিংবা নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিল? তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি না তুলে আত্মহত্যার ঘটনায় একটা বহিরাঙ্গিক কারণের ওপর দায় চাপানোর বিষয়টি কি সহজেই হচ্ছে না?
মুম্বাইয়ে ১৪ বছরের এক কিশোরের আত্মহত্যার ঘটনায় সতর্কধ্বনি বেজেছিল তদন্তকারীদের মনে। নড়েচড়ে বসেছিল পুলিশ প্রশাসন। আত্মহননকারী ওই কিশোরের বন্ধু দাবি করেছিল যে, মারা যাওয়া তার বন্ধুটি কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল, যার নাম ব্লু হোয়েল।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত পুলিশ কিন্তু ব্লু হোয়েল কানেকশনের কোনো প্রমাণ পায়নি।
মুম্বাইয়ের ওই ঘটনার পর এক মাসে আরো ছয়টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের পক্ষ থেকে ওই ঘটনায় দাবি করা হয়— ব্লু হোয়েলের কারণে এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পুলিশও এ যাত্রায়, পৃথক আত্মহত্যার ঘটনায় কোনো ব্লু হোয়েল গেমের কোনো প্রমাণ পায়নি।
আত্মহত্যার ঘটনার পাশাপাশি ওই একসময়ই খবর চাউর হয় যে ব্লু হোয়েলের খপ্পড় থেকে একাধিক কিশোর বেরিয়ে এসেছে।
ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দিরে এক ছাত্রকে স্কুলের ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার সময় রক্ষা করা হয়। ওই ঘটনায় স্কুল কর্তৃপক্ষের মনে ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ছাত্রটি গেমের জগতে ঢুকে পড়েছে। তবে ওই ছাত্রের মা দাবি করেন তার ছেলে কোনো ধরনের গেমে আসক্ত নয়।
পশ্চিম মেদিনীপুরের এক বাবা দাবি করেছিলেন যে, তার ছেলে ব্লু হোয়েল গেম খেলে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে ওই ছেলে দাবি করে সে কোনো গেম খেলে না। সে গেম সংক্রান্ত কিছু ধাপ সম্পর্কে জেনেছে। যা সে বিশ্বাস করে এগুলো ব্লু হোয়েল গেমের শর্ত। তার এক বন্ধু একটা ছবি পাঠায় এবং তাকে নির্দেশনামতো ইনবক্সে ছবি পাঠাতে বলে।
ব্লু হোয়েল গেম কি ধাপ্পাবাজি?
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কোনো কিশোর জানিয়েছে, তারা গেম খেলেন। পুলিশ আত্মহত্যার বিষয়টি উন্মোচন করতে তদন্ত শুরু করে। তবে তদন্তে পুলিশ ওই গেমের অস্তিত্বের বিষয়ে সংশয়-দ্বিধা প্রকাশ করে। তবে এটি পরিষ্কার ব্লু হোয়েল তত্ত্বটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমের কারণে একটা ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
ভারতের সাইবার বিশেষজ্ঞ প্রাণেশ প্রকাশ ব্লু হোয়েল গেমের অস্তিত্ব থাকার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, এটা গুজব ও গ্রামের গালগল্প ছাড়া কিছু নয়।
ওয়েবসাইট পর্যবেক্ষক সংস্থা স্নোপ ডটকম রাশিয়া ও ইউরোপে ‘ব্লু হোয়েল সম্পৃক্তায় আত্মহত্যার’ ঘটনা তদন্ত করে। তারা একশ’র বেশি আত্মহত্যার ঘটনার মোটিভ নিয়ে কাজ করে। স্নোপের তদন্তকারীরা ব্লু হোয়েল গেমের কোনো লিঙ্কের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেননি।
ব্লু হোয়েল গেমের উৎপত্তি রাশিয়ায় বলে প্রচার পেয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে। দেশটির ১৭ তরুণীর আত্মহত্যার পেছনে গেমের তথাকথিত উদ্ভাবক ফিলিপ বুদেকিনকে গ্রেফতার করা হয়। তারপরও দাবি উঠেছে— ব্লু হোয়েল গেম কোনো অজ্ঞাত অ্যাডমিন চালু রেখেছেন এবং তিনি কিশোর-কিশোরীদের গেম খেলতে বাধ্য করছেন।
চাপা পড়ে যাচ্ছে মানসিক দিক?
যে কারণেই হোক মৃত্যু ঘটছে। কেউবা আত্মহত্যা করছে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে ব্লু হোয়েল ইস্যুর কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি উপেক্ষিত থাকছে কি না? অনেকে দাবি করছে, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা নেট জগৎ থেকে জীবননাশী ওই খেলার লিঙ্কটি সরিয়ে দেওয়া হোক।
শিশু মনোবিদ ডা. অমিত সেন বলেন, আমার মনে হয় মৃত্যুর গভীর কারণে না গিয়ে গেমের ওপর দায় চাপানো সহজ। এবং সেটিই করা হচ্ছে। এর ফলে আসল কারণটি চাপা পড়ে যাচ্ছে। ৬-৭টি মৃত্যুর ঘটনায় ব্লু হোয়েল গেমের প্রসঙ্গ এসেছে। ভারতে প্রতিবছর অন্তত ৬৩ হাজার কিশোর-তরুণ আত্মহত্যা করে। যাদের বয়স ১০ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।
ওই চিকিৎসকের ভাষ্য : ব্লু হোয়েল মানসিক অসুস্থতার একটা কারণ হতে পারে। তবে কোনোভাবেই তা মৃত্যুর কারণ নয়।
কিশোরদের মৃত্যুর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। তারা একাডেমিক চাপে থাকে, নিঃসঙ্গ বোধ করতে পারে। তাদের অনেক সমস্যা থাকে যেগুলো শনাক্ত করা হয় না। তাদের মানসিক অসুস্থতা থাকতে পারে। যা তার মৃত্যুর কারণ নয় কী?— বলেন ওই চিকিৎসক।
অভিভাবক-শিক্ষকদের করণীয় কী?
অভিভাবকদের কেউ কেউ দাবি করছেন ব্লু হোয়েল গেমের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হোক। সাইট ব্লক করা ও অভিভাবকদের কড়া শাসন কিশোরদের মৃত্যুর মতো প্রবণতা কমাতে সহায়ক হবে। দিল্লী পাবলিক স্কুলের সাবেক অধ্যক্ষ সায়মা চৌহানা বলেন, কিশোরদের ইন্টারনেট ব্যবহারের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিশুরা ইন্টারনেট কেন ব্যবহার করবে, কতটুকু ব্যবহার কবে, কোন কাজে ব্যবহার করবে সে সম্পর্কে জানাতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিও গুরুত্ব দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
সূত্র : দ্য কোয়াইন্ট ডটকম।
একে/এমএস