জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণে রোহিঙ্গা সঙ্কট

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০২:০৩ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭

মিয়ানমারে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা রোহিঙ্গা সঙ্কটে যে ধরনের ভূমিকা রেখেছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারই সাবেক সহকর্মীরা। জাতিসংঘের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তা এবং ত্রাণ কর্মী বলেছেন, তিনি জাতিসংঘের কার্যালয়ে এমনকি রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো কথা বলতে পর্যন্ত নিষেধ করেছিলেন।

শরণার্থীদের অধিকারের বিষয় মিয়ানমার সরকারের কাছে উত্থাপনেও তিনি বাধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মিয়ানমারে জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার সূত্রগুলো বিবিসির কাছে এই অভিযোগ করেছে।

জাতিসংঘের একজন সাবেক কর্মকর্তার অভিযোগ, মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রধান কর্মকর্তা মানবাধিকার কর্মীদের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় যাওয়া থেকে বিরত রাখতে চেয়েছেন।

তবে মিয়ানমারে জাতিসংঘ দফতর বিবিসির এই প্রতিবেদনে উঠে আসা অভিযোগ অস্বীকার করেছে। গত মাসে যখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে, তখন থেকে এই সঙ্কট মোকাবিলায় সামনের কাতারে আছে জাতিসংঘ।

শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ ত্রাণ সাহায্য পাঠিয়েছে এবং মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের নিন্দা করে কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিয়েছে। তবে এই সঙ্কটের পূর্ববর্তী চার বছর ধরে মিয়ানমারে জাতিসংঘের কার্যক্রমের প্রধান রেনাটা লক ডেসালিয়েন রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে ভূমিকা পালন করেন, তা নিয়ে অনেক অভিযোগ তুলেছেন তারই সাবেক সহকর্মী এবং বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য রেনাটা লক ডেসালিয়েন এর আগে বাংলাদেশেও জাতিসংঘের প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। কানাডার নাগরিক রেনাটা লক ডেসালিয়েনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, রোহিঙ্গাদের এলাকায় মানবাধিকার কর্মীদের যেতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করা এ নিয়ে জনমত গড়ে তোলার কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করা রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টার ব্যাপারে সতর্কবাণী দিয়েছেন যেসব কর্মকর্তা, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করা

rohingya

মিয়ানমারে কাজ করেছেন এমন একজন ত্রাণ কর্মকর্তা ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি জানান, জাতিগত নির্মূলের চেষ্টা কিভাবে শুরু হয়, তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। রোয়ান্ডার গণহত্যার আগে ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে তিনি সেখানে নিজের চোখে দেখেছেন কী ঘটেছে।

তিনি যখন মিয়ানমারে এসে পৌঁছান, তখন সেখানেও এই একই প্যাটার্ন তার চোখে পড়েছে। তিনি জানান, মিয়ানমারে একদল বিদেশি এবং স্থানীয় ব্যবসায়ী, রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের নিয়ে কথা বলছিল।

আমি সেখানে ছিলাম। সেখানে একজন বৌদ্ধ বললো, রোহিঙ্গারা যদি কুকুরের মতো হয় ওদের সবাইকে মেরে ফেলা উচিত। কোনো সমাজে যখন একটি গোষ্ঠীকে আর মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয় না এবং সেটি যখন সমাজে স্বাভাবিক ব্যাপার বলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়, আমার কাছে এটাই জাতিগত নির্মূল শুরুর একটা আলামত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি এর আগে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, রোয়ান্ডা এবং নেপালে কাজ করেছেন। ২০১৩ সাল হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি মিয়ানমারে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কের দফতরের প্রধান ছিলেন তিনি। রেনাটা লক ডেসালিয়েন হচ্ছেন বর্তমানে আবাসিক সমন্বয়ক।

রাখাইনে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে যখন জাতিসংঘ কাজ করছে, তখন সেটি একেবারে সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন ক্যারোলাইন ভেনডেনাবিলি।

২০১২ সালে রোহিঙ্গা মুসলিম এবং রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে সংঘাতে নিহত হয়েছিল প্রায় একশো এবং সিটওয়ে শহরের আশে-পাশের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নেয় এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা।

এরপর মাঝেমধ্যেই সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের চেষ্টায় বাধা দিয়েছে রাখাইন বৌদ্ধরা। এমনকি তারা রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণবাহী গাড়ি বহরের পথ রোধ করেছে। ত্রাণবাহী গাড়িতে হামলা চালিয়েছে।

জাতিসংঘ এবং ত্রাণ সংস্থাগুলোর জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠলো। রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের একই সঙ্গে মিয়ানমার সরকার এবং স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাহায্য দরকার।

অন্যদিকে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা এটাও বুঝতে পারছিলেন যে, রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও নাগরিকত্ব নিয়ে কথা বললে সেটা মিয়ানমারের অনেক বৌদ্ধকে ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে।

এ অবস্থায় জাতিসংঘ একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের সিদ্ধান্ত নেয়। রাখাইনে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, যদি সেখানে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়, তাতে রোহিঙ্গা আর বৌদ্ধদের মধ্যে উত্তেজনা কমে আসবে।

কিন্তু এর ফল দাঁড়ালো এই, রোহিঙ্গা বিষয়ে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা আর প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে চায় না। রোহিঙ্গা নিয়ে কথা বলা যেন একটা 'নিষিদ্ধ' ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। জাতিসংঘের প্রেস বিজ্ঞপ্তিগুলোতে রোহিঙ্গা শব্দের ব্যবহারই পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। মিয়ানমারের সরকারও রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করে না। তারা রোহিঙ্গাদের 'বাঙালি' বলে।

মিয়ানমারে কর্মরত ত্রাণকর্মীদের একাধিক সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, উচ্চ পর্যায়ের জাতিসংঘ বৈঠকে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা রীতিমত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

rohingya

ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি বলেন, শীঘ্রই এই বিষয়টি সবার কাছে পরিস্কার হয়ে যায় যে, উচ্চ পর্যায়ের জাতিসংঘ বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলা কিংবা জাতিগত নির্মূল অভিযানের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

তার ভাষায়, আপনি হয়তো এটা করতে পারেন, কিন্তু সেটার একটা পরিণতি ভোগ করতে হবে। এর অনেক নেতিবাচক পরিণতি আছে। আপনাকে আর কোনো সভায় ডাকা হবে না। আপনার ভ্রমণের অনুমতিপত্র ঠিকমত পাওয়া যাবে না। অনেক কর্মী তাদের কাজ হারিয়েছেন। তাদেরকে সভার মধ্যে হেনস্থা করা হয়েছে। এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হল যে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথাই বলা যাবে না।

এত বিধি-নিষেধের পরও যারা এই কাজ বারবার করেছেন, তাদের আলোচনা থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে। যেমন জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ বিষয়ক দফতরের (ইউএনওসিএইচএ) প্রতিনিধি।

ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি জানান, তাকে সবসময় নির্দেশনা দেয়া হতো বৈঠকগুলো যেন এমন সময়ে আয়োজন করা হয়, যখন ইউএনওসিএইচএ'র প্রতিনিধি শহরে থাকবেন না।

তিনি আরও বলেন, তাকে গন্ডগোল সৃষ্টিকারি বলে চিহ্নিত করা হয় এবং রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের আশঙ্কা নিয়ে বারবার সতর্ক করায় তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।

মিজ ভ্যানডেনাবিলি যেসব ঘটনা বর্ণনা করেছেন, জাতিসংঘ তার কোনো প্রতিবাদ জানায়নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলতে মিয়ানমার সফরে যাওয়া জাতিসংঘ কর্মকর্তাদেরও নিষেধ করা হতো।

টমাস কুইটানা এখন উত্তর কোরিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তা। এর আগে তিনি ছয় বছর মিয়ানমার বিষয়ে ওই একই দায়িত্বে ছিলেন। আর্জেন্টিনা থেকে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন।

ইয়াংগন বিমানবন্দরে একবার তার দেখা হয় রেনাটা লক ডেসালিয়েনের সঙ্গে। টমাস কুইটানা জানান, তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন, আপনার উত্তর রাখাইনে যাওয়া উচিত হবে না, দয়া করে ওখানে যাবেন না। আমি তখন জানতে চাইলাম, কেন? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ছিল না। তার অবস্থানটা ছিল এ নিয়ে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় তিনি যেতে চান না।

তিনি আরও বলেন, এটা মাত্র একটা ঘটনা। কিন্তু এ থেকে বোঝা যায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারে অবস্থানরত জাতিসংঘ দলের কৌশলটা কী ছিল।

rohingay

তবে রেনাটা লক ডেসালিয়েনের পরামর্শ উপেক্ষা করে মিস্টার কুইনটানা উত্তর রাখাইনে যান এবং এক্ষেত্রে তিনি মিয়ানমারের জাতিসংঘ মিশনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি।

জাতিসংঘের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে আমরা আসলে সেখানে রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে কাজ করার চেষ্টা করছিলাম।

তিনি আরও বলেন, সরকার আসলে খুব ভাল করেই জানে আমাদের কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, কিভাবে কাজে লাগাতে হয় এবং তারা সেটাই করে যাচ্ছিল। অথচ আমরা কখনোই এ থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করিনি। আমরা কখনোই মিয়ানমারের সরকারের সামনে পিঠ সোজা করে দাঁড়াতে পারিনি, কারণ তাতে নাকি মিয়ানমার সরকার ক্ষেপে যাবে।

২০১৫ সালে জাতিসংঘ নিজেই মিয়ানমারে তাদের দফতরের কাজ নিয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনার পর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট বিবিসির হাতে এসেছে। এতে মিয়ানমারে জাতিসংঘ দফতরের কাজের কঠোর সমালোচনা রয়েছে।

জাতিসংঘের নতুন মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাস দায়িত্ব নেয়ার পর তার জন্য তৈরি করা এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে, মিয়ানমারে জাতিসংঘ একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

রেনাটা লক ডেসালিয়েন এখনো মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রধান কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন। তার জায়গায় নতুন যে কর্মকর্তার নাম পাঠানো হয়েছিল, মিয়ানমার সরকার তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে মিজ ডেসালিয়েন এখনো তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

রেনাটা লক ডেসালিয়েন এসব বিষয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

আর মিয়ানমারে জাতিসংঘের দফতরের একজন মুখপাত্র এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলার বিষয়ে রেনাটা লক ডেসালিয়েন কোন বাধা দিয়েছেন।

তবে অন্য অনেকেই মিয়ানমারে জাতিসংঘের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে শ্রীলংকায় জাতিসংঘ যে ভূমিকার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিল, তার অনেক মিল দেখতে পাচ্ছেন।

চার্লস পেট্রি শ্রীলংকায় জাতিসংঘের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে একটি রিপোর্ট লিখেছেন। তিনি মিয়ানমারে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। ২০০৭ সালে তাঁকে মিয়ানমার থেকে বহিস্কার করা হয়।

তিনি বলেছেন, মিয়ানমারের জাতিসংঘের গত কয়েক বছরের ভূমিকা বিভ্রান্তিকর।

জাতিসংঘ কি মিয়ানমারে কোন ভিন্ন কৌশল নিলে এই বিপর্যয় এড়ানো যেতো?

ক্যারোলাইন ভ্যানডেনাবিলি মনে করেন, অন্তত তিনি যেসব আগাম সতর্কবাণীর কথা বলেছিলেন, তা আমলে নিলে হয়তো সবাই আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে পারতো কী ঘটতে চলেছে।

একটি সূত্র বলছে, রাখাইনে রোহিঙ্গা সংকটের ব্যাপারে যেভাবে মিয়ানমারে জাতিসংঘ কাজ করেছে, তার জন্য একটি আভ্যন্তরীণ তদন্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে সংস্থাটি।

সূত্র : বিবিসি

কেএ/আইআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।