আমার ছেলেকে ফিরত আইনে দেও বাবা


প্রকাশিত: ০৫:২২ এএম, ১৬ জুন ২০১৫

দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলেও বিভিন্ন সময়ে নদী পথে মালয়েশিয়ায় যাওয়া যশোরের শার্শার ১৩ যুবকের খোঁজ মেলেনি আজো। নদী পথে মালয়েশিয়া যাওয়া ওই ১৩ যুবকের পরিবার পরিজনদের গ্রামে আজ শুধুই কান্নার রোল। পরিবারে উপার্জনক্ষম ছেলে ও স্বামীকে হারিয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অভাবের সংসারে নির্বাক পরিবারের নারী সদস্যরা। শোকে অনেকের চোখের জল শুকিয়ে গেছে।  

মানবপাচারের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরো ১৫ জনের নামে শার্শা থানায় মামলা করেছে।  চান্দু ও শফিকুল ইসলাম নামে ২ মানব পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবি নামে এক মানবপাচারকারীর বাড়ি থেকে ১৩টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে। বাকিদের আটকের চেষ্টার কথা বলা হলেও তারা রয়েছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

শার্শার বিত্তিবারিপোতা, বলিদাদাহ, নারানপুর, পান্তাপাড়া,  গঙ্গানন্দপুর, খড়িডাঙ্গা, গয়ড়া ও ঘিবা গ্রামের ১৩ যুবক মালয়েশিয়ায় পাড়ি দিতে যায় নদী পথে। ২-৩ বছর যাবৎ তাদের কোনো খোঁজ নেই।  সংসারের অভাব অনটন দূর করতে মোটা অঙ্কের টাকা রোজগারের আশায় নদীপথে টেকনাফ হয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে তারা নিখোঁজ হন। বর্তমানে তারা বেচেঁ আছেন না মারা গেছেন তাদের পরিবারের কেউ জানে না। পরিবারের লোকজন আশায় বুক বেঁধেছেন, একদিন তারা বাড়ি ফিরে আসবেন।

স্থানীয় দালাল চান্দালীর ছেলে আকবার ও সামসুর রহমানের ছেলে শুকুর আলীর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কোনো অর্থ ছাড়াই বিদেশ পাড়ি দেয়ার আশায় বুক বাঁধে বিত্তিবাড়িপোতা গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে জামাল হোসেন, আয়ুব আলীর ছেলে মোহর আলী, মুজিবুর রহমানের ছেলে মুনসুর আলী ও নজরুল ইসলাম, নারানপুর গ্রামের সামসুর রহমানের ছেলে তাহাজ্জত হোসেন তানা, বলিদাদহ গ্রামের জাহান আলীর ছেলে মোকলেস আলী, শার্শার পান্তাপাড়া গ্রামের আব্দুল খালেকের ছেলে ইকলাস হোসেন, গঙ্গানন্দপুর গ্রামের সামাদ আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম, ইদ্রিস আলীর ছেলে মেহেদী হাসান, আতিয়ারের ছেলে রাসেল হোসেন, বেনাপোলের খড়িডাঙ্গা গ্রামের নজরুলের ছেলে শাহিন, গয়ড়া গ্রামের ছিদ্দিক মিস্ত্রির ছেলে নজরুল ও ঘিবা গ্রামের মতিয়ারের ছেলে আলামিন।  তারা মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে আর ফিরে আসেনি।  এখন তারা কোথায় কী অবস্থায় আছেন তাও জানে না কেউ।

বিদেশে গিয়ে বেশি টাকা আয় করে একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন এসব যুবক।  কিন্তু এজেন্সির চাহিদা ২ লাখ টাকা পরিশোধ করার সাধ্য ছিল না তাদের।  হঠাৎ একদিন সুযোগ আসে মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার।  বাকি টাকা সেখানে কাজ করে পরে শোধ করতে হবে।  এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি অনেকে।  আবার অনেকে সংসারে সুখের আশায় সহায় সম্বল, জমি, ফলজ ও বনজ গাছ, গরু-ছাগল হাঁস মুরগি বিক্রি করে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা তারা পর্যায়ক্রমে তুলে দেয় দালালের হাতে।  এরপর তাদের টেকনাফের হারুন দালালের মাধ্যমে নদী পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন।  সেই থেকে আজ পর্যন্ত ওই ১৩ যুবকের কোনো খোঁজ নেই।

 

ট্রলার ও জাহাজ ডুবিতে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন আত্মরক্ষায় জাহাজ থেকে ঝাপ দিয়ে পালিয়ে আসা ইকলাস হোসেন।  তাকে দা নিয়ে তাড়া করেন দালালরা।  এসময় ইকলাসের সঙ্গে আরো ৭ জন পালিয়ে এলেও জাহাজে থাকা ৩৫০ জনের করুণ কাহিনী বলতেই কেঁদে ফেলেন ইকলাস।

নিখোঁজ তাহাজ্জত হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় বাড়িতে কেউ নেই।  বাড়ির সঙ্গের রাস্তায় তার তিন ছেলে-মেয়ে খেলা করছে।  মা তাদের বাড়িতে রেখে মাঠে দিন মজুরির কাজ করতে গেছেন।  সাংবাদিক এসেছে শুনে চারদিক থেকে লোকজন আসতে শুরু করেন।  সবার মুখে একই কথা, তার কী কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে।?

কিছুক্ষণ পর ছুটে আসেন তাহাজ্জত হোসেনের স্ত্রী ও বিধবা মা।  মা লতিফুন্নেছা হাউমাউ করে কেঁদে বলেন, আমার ছেলেকে ফিরত আইনে দেও বাবা।  দুই বছর ধরে আমার ঠিক মতো খাওয়া-ঘুম নেই।  কে দেখবে আমাদের? বউমা দিনমজুরের কাজ করে যা আয় করে তা দিয়ে সংসার চলে না। ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনাও সেই থেকে বন্ধ হয়েছে।

নিখোঁজ মুুজিবর রহমানের স্ত্রী ফাহিমা খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, বাসা-বাড়িতে ও মাঠে কাজ করে চলছে বর্তমানে তাদের সংসার।  স্বামীর খোঁজ তারা আজো পাননি।  একই কথা বলেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী শেফালি বেগমও।  জামাল হোসেনের মা হামিদা খাতুন কথা বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। ম্বামী ও সন্তানকে ফিরে না পাওয়ার বেদনায় হতবিহব্বল তারা।  নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা তাদের স্বজনদের জীবিত বা মৃত ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়েছেন সরকারের কাছে।

তাহাজ্জত হোসেনের পরিবারের মত নিখোঁজ প্রতিটি পরিবারে এখন কান্না।  সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষ নিখোঁজ হওয়ায় পর অভাবের তাড়নায় পথে বসেছে পরিবারগুলো।  বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকটি পরিবারে সন্তানদের খেলাপড়া।  এ পর্যন্ত কেউ দাঁড়ায়নি অসহায় পরিবারগুলোর পাশে।  স্বজনরা দালালের কাছে নিখোঁজদের সন্ধান নিতে গিয়ে হুমকির শিকার হয়েছেন।  ভয়ে অসহায় পরিবারগুলো এতদিন মুখ বন্ধ করে ছিল।  বিদেশে মানবপাচার নিয়ে দেশ-বিদেশে সংবাদ প্রকাশিত হলে সাহস পেয়ে সাংবাদিক ও পুলিশের কাছে মুখ খোলেন এসব পরিবার।

শার্শা সদর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুল খালেক জাগো নিউজকে বলেন, এ নিয়ে কয়েকবার গ্রামে বৈঠক করা হয়েছে।  তবে দালালরা রয়েছে বহাল তবিয়তে।

এ ব্যাপারে শার্শা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইনামুল হক জাগো নিউজকে জানান, নিখোঁজ পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে পুলিশ বাদী হয়ে গত ২৮ মে ৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত পরিচয় আরো ১৫ জনের নামে মামলা করেছে।  চান্দু ও শফিকুল ইসলাম নামে ২ মানব পাচারকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।  এছাড়া, তবি নামে এক মানবপাচারকারীর বাড়ি থেকে ১৩টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।  বাকিদের আটকের চেষ্টা চলছে বলে জানান ওসি।

এ ব্যাপারে শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার এটিএম শরিফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, প্রকৃত তথ্য জানা নেই তাদের।  তবে নিখোঁজ সদস্যদের খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে।

শার্শা উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক মনজু জাগো নিউজকে বলেন, পাচার প্রতিরোধে আমরা বিভিন্ন সময় এলাকাবাসীকে সচেতন করে আসছি।  কিন্তু তারপরো এসব যুবকরা দালালের মিথ্যা প্রলোভনে পা দেয়ায় এ ঘটনা ঘটেছে।  নিখোঁজ যুবকদের সন্ধান পেতে আমরা বিভিন্নভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছি।

মো. জামাল হোসেন/এমজেড/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।