রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে শঙ্কায় বাংলাদেশ
গত বছরের এই সময়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের অধিকারের ব্যাপারে আলোচনা করেছিলেন তারা।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা ঘিরে সমালোচনার মুখে এ বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিচ্ছেন না সু চি। তবে জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেছেন।
গত ২৫ আগস্ট সীমান্ত খুলে দেয়ার পর বাংলাদেশে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে। মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের রাখাইন থেকে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গাদের ঢল শামলাতে লড়াই করছেন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং দাতা সংস্থাগুলো।
একই সময়ে এই বিশালসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া নিয়েও বেশ চিন্তিত ঢাকা। চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে শরণার্থীদের দলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, আমাদের প্রধান সমস্যা হলো স্থান সংকুলান। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত স্থানের সঙ্কট রয়েছে; বিশেষ করে ওই এলাকায় যেখানে আগে থেকেই রোহিঙ্গা রয়েছে।
এই রাষ্ট্রদূতের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। এমনকি চলতি আগস্টে সঙ্কট শুরুর আগে থেকেই পূর্ববর্তী সহিংসতায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যাওয়া নথিভূক্ত এবং নথিবিহীন প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় হয়েছে বাংলাদেশে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সহিংসতায় প্রায় ৪ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এদের অনেকেই আগুনে ঝলসানো, বুলেট এবং মাইন বিস্ফোরণের ক্ষত নিয়ে সাীমান্ত পাড়ি দিয়েছে। কিন্তু এই রোহিঙ্গাদের প্রায় ৪০ শতাংশই প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এছাড়া পাঁচ বছরের কম বয়সী এক লাখ ৫৪ হাজার শিশু ও ৫৫ হাজার গর্ভবতী নারীসহ প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গার জরুরি খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।
সোমবার জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফান দুজারিক বলেছেন, আমরা জানি সাম্প্রতিক বন্যাসহ অন্যান্য সঙ্কট মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। আমাদের মানবিক সহকর্মীরা একটি যৌথ পরিকল্পনা করছেন। এতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহায়তা প্রয়োজন হবে। এছাড়া বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করছেন তারা। তবে ঠিক কি পরিমাণ আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন হবে সেবিষয়ে কোনো ধারণা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তিনি।
প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা পেতে পারে বাংলাদেশ। নিউ ইয়র্কে চার দিনের সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ফোরামে তুলে ধরবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ভাষণে ও ২১ সেপ্টেম্বর মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরাসের সঙ্গে বৈঠকেও রোহিঙ্গা ইস্যু তুলে ধরবেন তিনি।
তুরস্ক, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরানসহ সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছে। এছাড়া আরো অনেকেই লাখ লাখ ডলার সহায়তার অঙ্গীকার করেছেন।
মোমেন বলেন, অবশ্যই সীমিত অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের এই স্রোত চাপ (বাংলাদেশের অর্থনীতিতে) প্রয়োগ করবে। কিন্তু এই চাপ আমাদের বিবেককে ঠেকাতে পারবে না। আমাদের প্রধান চাওয়া হলো এই মানুষদের নিরাপদ ও যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে দেশে ফেরার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা বন্ধে দেশটির সরকারকে বশে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। গত সপ্তাহে অ্যান্তোনিও গুতেরাস বলেছেন, সু চির প্রশাসন আমাদের অনুরোধ কর্ণপাত করেনি।
এদিকে, দীর্ঘদিন ধরে এই শরণার্থীরা অবস্থান করলে রাখাইনের রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মৌলবাদ ছড়ানোর শঙ্কাই বাংলাদেশের বড় উদ্বেগের বিষয়।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আপনি জানেন, যখন আপনি মানুষকে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ঠেলে দেবেন, যখন তাদের পিঠ ঠেকে যাবে; তখন সেই পরিস্থিতিতে সুবিধা গ্রহণ করার মতো অনেক গোষ্ঠীকেই পাবেন; যা আজকের দুনিয়ায় সব সময় দেখা যায়।
স্থানীয় কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছেন; বিশেষ করে তরুণদের ওপর। জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশি এই কর্মকর্তা বলেন, তারা অন্যদের সঙ্গে মিশুক আমরা তা চাই না। এটা সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ কারণ ভাষা অথবা উপভাষার সঙ্গে আমাদের সামান্য মিল আছে। সুতরাং যদি তাদের মধ্যে চটপটে কেউ থাকে তাহলে তারা মূলধারার জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশতে পারে।
সূত্র : কোয়ার্টজ।
এসআইএস/আইআই