বিএনপি ভারত বিরোধী রাজনীতি করবেই!

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:০৭ এএম, ১০ জুন ২০১৫

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপি যে কথা বলেছে তারা কখনো ভারত বিরোধী রাজনীতি করেনি, করছে না এবং কখনো করবেও না, কিছুদিনে মধ্যেই দেখা যাবে সেটা ছিল কথার কথা। ১৯৭৮ সালে জন্মের পর থেকে এই দলটি ‘এন্টি ইন্ডিয়ান ও এন্টি আওয়ামী লীগ সেন্টিমেন্টকে’ কাজে লাগিয়ে আসছে। দলটি ভারত বিরোধিতা নীতির ফলও পেয়েছে। কখনো ক্ষমতায় গিয়ে আবার কখনো ক্ষমতায় যেতে না পেরে।

যতদিন এদেশে জামাতের রাজনীতি করার অধিকার থাকবে, ততদিন জামাতের সঙ্গে জঙ্গিবাদের সম্পর্ক থাকবে এবং বিএনপি যদি জামাতের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলে ততদিন বিএনপির ভারতবিরোধী রাজনেতিক কৌশলও বহাল থাকবে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তারে ভারতের আতঙ্ক এবং বিএনপির সাথে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসএইয়ের কথিত সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগের প্রশমন না করা পর্যন্ত ভারতও বিএনপির দিকে ঝুঁকবে না।
 
আবার এটাও শিকার করতে হবে যতদিন সীমান্তে হত্যা বন্ধ না হবে, দুদেশের বাণিজ্য ঘাটতি না কমবে, তিস্তা চুক্তি না হবে, গঙ্গায় পানি না আসবে ততদিন এদেশে ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্ট কিছু মানুষের মধ্যে বহাল থাকবে। এই সেন্টিমেন্ট আবার বিএনপিও ক্যাশ করতে চাইবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদরা যতই সমীকরণ দেখান না কেন যে ভারত বিরোধিতার রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে, বিএনপি বলেছে আর জীবনে ভারতবিরোধী রাজনীতি করবে না তা যে আসলে সাময়িক কৌশল সেটা কিছুদিনের মধ্যেই টের পাওয়া যাবে।

বিশ্লেষণ করা দরকার কোন পর্যায়ে এসে বিএনপি এখন সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা করছে যে তারা কখনো ভারত বিরোধী রাজনীতি করবে না। মোদির সফরকে স্বাগত জানিয়ে তারা এটাও স্মরণ করে দিয়েছে যে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল পাসকেও স্বাগত জানিয়েছে। (যে চুক্তির আলোকে এই বিল পাস হয়েছে, মুজিব ইন্দিরা চুক্তি, সেটিকে এতোদিন তারা গোলামীর চুক্তি বলেই প্রচরাণা চালিয়ে এসেছে।)  বিএনপির একটা অংশ এখন অনুধাবন করেছে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত একটা বড় ফ্যাক্টর। বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি জনগণকে সম্পৃক্ত না করে পশ্চিমা বিশ্বকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ সরকারকে দিয়ে তত্ত্বাবধায়কর সরকার গঠনের দাবি মানাতে চেষ্টা করেছিল। পশ্চিমা কূটনীতিকদের দিয়ে তারা নির্বাচন ঠেকাতেও কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু জামাত ও হেফাজতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক, জঙ্গিবাদের উত্থানে তাদের নীরব সমর্থন এবং পাকিস্তানিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলায় ভারত বিএনপির ওপর ভরসা রাখতে পারেনি। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় ছিল। ভারতই সেখানে আপত্তি জানায়। বিষয়টি নিয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিয়ে ওবামার সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও আলোচনা করেছেন।

ওবামার সাথে আলোচনা করাটা প্রমাণ করে ভারত তার প্রতিবেশী বাংলাদেশের নির্বাচনকে কতোটা গুরুত্ব দিয়েছিল। সেসময় নির্বাচন নিয়ে দুটি বলয় গড়ে ওঠে, যেমনটি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। একটি পক্ষ তৈরি হয় ভারত রাশিয়া ও চীনকে ঘিরে, আরেকটি বলয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেনসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী মনমোহনের সাথে বৈঠকে ওবামা দক্ষিণ এশিয়ায় নীতি নির্ধারণে ভারতের সাথে নতুন করে কথা বলতে তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন ভারতের শক্ত অবস্থানের কারণে পশ্চিমারা তাদের চিন্তায় পরিবর্তন আনে এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিকে বাদ দিয়েই করার ব্যাপারে চুপ থাকে। নির্বাচনের পরে নতুন সরকারের সাথেও আগের মতোই নীতি বহাল রেখে চলবে বলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি আজ বলতে বাধ্য হচ্ছে তারা কখনোই ভারতবিরোধিতা করেনি বা করবে না। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভারত বিরোধী মনোভাবকে পূঁজি করে রাজনীতির যে ধারা চালু হয়েছে বিশ্ব রাজনীতির পালাবদলে সেই কৌশল এখন অচল হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই ‘অচল মুদ্রা’ই স্বর্ণমুদ্রার মতো বিএনপি কাজে লাগাবে। আগামি নির্বাচনের সময় সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় থেকেই শুনে আসছি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ ভারতের করদ রাজ্য হয়ে যাবে। প্রতিটি নির্বাচন আসে আর বিএনপি প্রচারণা চালায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে দেশ হিন্দুদের দখলে চলে যাবে। যদিও মাঝখানে ২০১২ সালের অক্টোবরে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের পর রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতায় পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছিল। ভবিষ্যত রাজনীতিতে দুদেশের সম্পর্ক ও বিএনপির সাথে সম্পর্কের নতুন করে সংজ্ঞায়নে ভারত সরকার খালেদা জিয়ার সফরকে যে মর্যাদা দিয়েছিল তাতে আওয়ামী লীগের কারো কারো গাত্রদাহ হয়েছিল ঠিকই। দেশে পা রেখেই খালেদা জিয়া বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবেও বলেছিলেন ভারতের আতিথেয়তায় তিনি মুগ্ধ এবং ভারতের প্রতি তার দলের দৃষ্টিভঙ্গি এই মুহূর্ত থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে।

ওই সময় বিএনপির কাছে ভারতের চাওয়ার মধ্যে অন্যতম ছিল পাকিস্তানিদের সাথে দহরম মহরম বন্ধ করা, জামাতের সাথে সম্পর্কে দূরত্ব বজায় রাখা, জঙ্গিবাদ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখা, ক্ষমতা গেলে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া। খালেদা জিয়া ভারতের এই চাওয়া পূরণ করবেন বলেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরেই তিনি দলের ভেতরে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে পড়েন। যে দলটির মধ্যে পাকিস্তানি ভাবধারার নেতার সংখ্যার আধিক্য এবং জামাতি প্রভাব ভয়াবহ সেখানে খালেদা জিয়া চাপে পড়বেন এটা খুবই স্বাভাবিক। বিএনপির অঘোষিত উপদেষ্টা ফরহাদ মজহার আর মাহমুদুর রহমানরা কলাম লেখা শুরু করে দিলেন, তারা বোঝাতে চাইলেন বিএনপি ভারত বিরোধী নীতি থেকে সরে আসলে রাজনীতিতে হেরে যাবে। শেষ পর্যন্ত দলের মধ্যে ভারত বিরোধী অংশেরই বিজয় হয়েছে।

পরবর্তী সময়ে ২০১৩ সালের মার্চে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশ সফরে আসলে খালেদা জিয়া তার নির্ধারিত সৌজন্য সাক্ষ্যাৎ বাতিল করে দেন। তাদের ডাকা হরতাল উপেক্ষা করে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে না গিয়ে শিষ্টাচার লঙ্ঘনের কতো বড়ো উদাহরণ তৈরি করলেন সেটা হয়তো তখন বোঝার ক্ষমতা বিএনপির কারো ছিল না। এরপরেও বিএনপি নেতৃত্ব কথায় কথায় ভারত বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে। এরই মধ্যে বিএনপি জামাতের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করেছে, নতুন করে হেফাজতকে আস্কারা দিয়েছে। ভারত বিএনপির এ আচরণে হতাশ হয়েছে। দশম সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে না পেরে ২০১৪ সালের মার্চে ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে খালেদা জিয়া বলেছেন একতরফা নির্বাচনে সমর্থন দিয়ে ভারত বাংলাদেশের মানুষের কাছে থেকে দূরে সরে গেছে। অর্থাৎ ২০১২ সালে যে ভারতকে খালেদা জিয়া বন্ধু বলেছিলেন পরের বছর থেকে সেই ভারত আবার শত্রু হয়ে গেছে। বিএনপি আগের অবস্থানে ফিরে গেছে।  পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ভারতের চাওয়া পূরণ করে চলেছে।

২০১৫ সালের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এবার বিএনপি বলছে আর জীবনেও ভারত বিরোধিতা করবে না। ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসায় বিএনপি শিবিরে ভারত বিরোধী রাজনীতির কৌশল নিয়ে নতুন করে চিন্তা ভাবনা শুরু হয়। আওয়ামী লীগের সাথে কংগ্রেসের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। দীর্ঘদিন ভারত শাসন করা কংগ্রেসের পরাজয়ে বিএনপি ভাবতে শুরু করেছে এবার বিজেপি সরকারের সাথে তাদের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে আওয়ামী লীগকে ভারতের কাছে দূরে ঠেলে দিতে হবে। কিন্তু ভারত যে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে তার বিদেশ নীতিতে খুব একটা পরিবর্তন আনে না সেটা এবারও তারা বুঝিয়ে দিয়েছে।

কংগ্রসের আমলে বিএনপির অবস্থানের কথা বিজেপি সরকারের ভারতও ভুলে যায়নি। মোদির সাথে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের কথোপকথন সেটাই প্রমাণ করে। মোদির কাছে খালেদা জিয়া নালিশ করে বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। মোদি জবাব দিয়েছেন তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। পাশাপাশি মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদেও ভারত যে বিশ্বাস করে না একথা বলে খালেদা জিয়াকে জামাতি সঙ্গ ত্যাগেরই বার্তা দিলেন মোদি। আর বিএনপির মিত্র জামাত-এর বিবৃতিতে মোদির এই সফরে জনগণ হতাশ হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে।

এখন বিএনপি কী কৌশল নেবে সেটা দেখার বিষয়। ক্ষমতায় আসতে হলে ভারতকে দরকার এটা যেমন বিএনপি বুঝতে পারছে তেমনি জনগণকেও দরকার। আবার জামাতকেও বাদ দিতে পারছে না। এছাড়া এখনো ভারতের সাথে কিছু কিছু সমস্যা ঝুলে আছে। এখনো তিস্তা চুক্তি হয়নি। যদিও এবারের সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রাজ্যসরকারগুলোর সাথে আলোচনা করে একটা সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছানো যাবে। মোদি এ নিয়ে কোনো সময়সীমার কথা বলেননি।

২০১১তে যে চুক্তি হওয়ার কথা ২০১৫তে তা করতে পারেনি ভারত। গঙ্গায়ও পানি প্রবাহ ঠিক নেই, সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে কোনো বাংলাদেশি মারা যাবে না এটা হলফ করে বলা যায় না। ভারতে যেতে ইচ্ছুক লাখ লাখ মানুষকে ভিসা দিতে হয়রানি করা হবে না সে নিশ্চয়তাও নেই। জনগণের একটা অংশ এসব ইস্যুতে ভালো রকমেরই বিরক্ত। সমস্যা ঝুলিয়ে রেখে সম্পর্ককে উচ্চমাত্রায় নিয়ে যাওয়া যায় না এটা এদেশের মানুষ জানে। বিএনপি কী এসবকে ইস্যু করবে না?

বিএনপি মানুষের ওই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাবেই। যতোই বলা হোক ডিজিটাল যুগে আগের মতো এখন মিথ্যা প্রচারণার বেইল নেই, এটা মানতে হবে এদেশের অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক গালমন্দ এখনো পছন্দ করে। ওই সমস্ত মানুষকে বিভ্রান্ত করে নিজ দল বা জোটের পক্ষে ভোট নিয়ে আসার সুযোগ বিএনপি নেবেই। তাই এটা বলা যাচ্ছে না ভারত বিরোধী রাজনীতি এদেশে আর হবে না। ভারত বিরোধী রাজনীতির কার্ড বিএনপি জামাত জোট খেলবেই।

যে কেউ বলতেই পারেন এসব ইস্যু নিয়ে কথা বলাতো দেশের পক্ষেই কথা বলা। হ্যা, এটা মানতে হবে দেশের স্বার্থের কথা বললে কিছু কথা ভারতের বিপক্ষে যাবেই। কিন্তু এই সস্তা রাজনৈতিক সেন্টিমেন্ট কাজে লাগাতে গিয়ে বিএনপির ভেতরে পাকিস্তানপন্থি ও জামাত ভাবধারার অংশটিই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। নীতি নির্ধারণে তখন ওই অংশটিই মূল ভূমিকা রাখবে। তখন আবার আইএসআইয়ের সাথে যোগাযোগ বাড়বে। জঙ্গিবাদ দমনও কঠিন হবে। আমার আশঙ্কার জায়গা ওখানেই।



এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।