অপরিকল্পিত শিক্ষক প্রশিক্ষণে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম বিপর্যস্ত


প্রকাশিত: ০৫:০৩ এএম, ৩০ মে ২০১৫

জয়পুরহাটে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপরিকল্পিত প্রশিক্ষণের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের উপর। বিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষককে দীর্ঘ দিন ধরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অবস্থান করায় স্থবির হয়ে পড়েছে জেলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। শিক্ষক না থাকায় অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতিও কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। এ অবস্থা আরো চলতে থাকলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।

সরেজমিনে জানা গেছে, জয়পুরহাট সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (পিটিআই) এখন চলছে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষক প্রশিক্ষণের মহােৎসব। ১৬ মে থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত দুইটি ব্যাচে ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ৮০ জন সহকারি শিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য `ডিপ্লোমা-ইন-প্রাইমারি এডুকেশন` প্রশিক্ষণ এখন চলছে এই পিটিআই সেন্টারে। অন্যদিকে জেলার ৩৫ জন প্রধান শিক্ষকের ২৩ মে থেকে ২৭ মে পর্যন্ত একই ট্রেনিং হয়ে গেল। এছাড়া ১২ দিন ধরে আইসিটি বা ইনফরমেশন অব কম্পিউটার টেকনোলজি বিষয়ক ট্রেনিং নিচ্ছেন জেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০ জন শিক্ষক।

আপাত দৃষ্টিতে এটা ইতিবাচক দিক হলেও শুধু পরিকল্পনাহীন প্রশিক্ষণের জন্য এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদ্যালয়গুলোতে। প্রশিক্ষণরত জয়পুরহাট শহরের মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহান-ই-জান্নাত জাগো নিউজকে জানান, এ প্রশিক্ষণের ফলে পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে শিক্ষকদের এসব প্রশিক্ষণ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিকাশে অনেকখানি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

একই বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণরত শিক্ষক সাবরিনা সিগমা জাগো নিউজকে বলেন, অধিকাংশ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে গ্রীষ্মকালীন ছুটির মধ্যে। এরই মধ্যে গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল হলে পাঠদান বেশ কিছুটা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

জয়পুরহাটের বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে, জয়পুরহাট শহরের মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ৮ জন,  জয়পুরহাট সরকারি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ২শ জন শিক্ষার্থী জন্য ৬ জন শিক্ষকের মধ্যে ৫ জন, পশ্চিম জয়পুরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাড়ে ৩শ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৭ জন শিক্ষকের মধ্যে ৪ জন সহকারীসহ প্রধান শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন।

এছাড়াও কাশিয়াবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ জন, তেঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ জন, তেঘর প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ২ জন, সদর উপজেলার কোমর গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ জন, ভাদশা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩ জন, পুরানাপৈল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২ জন ও পারুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২ জন শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন। একই ভাবে জেলাসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে একাধিক শিক্ষককে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে। প্রশিক্ষণে এসব শিক্ষক অংশগ্রহণ করার কারণে বিদ্যালয়গুলোতে দেখা গেছে শিক্ষাকার্যক্রমের বেহাল দশা। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক স্বল্পতার কারণে ২/১ জন শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না পাঠদান।

পশ্চিম জয়পুরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, আগামী ডিসেম্বর মাসে তার অবসরে যাওয়ার কথা। তিনিসহ মোট ২ জন শিক্ষক এতগুলো শিক্ষার্থীদের কিভাবে পড়াবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

এ ভাবে কোথাও মাত্র ১ জন, কোথাও বা ২ জন শিক্ষককে দিয়ে সকল শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একত্রে জড়ো করে চলছে পাঠদান। আবার শিক্ষক স্বল্পতার কারণে বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশুনা হচ্ছে না বলে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির হার দেখা গেছে ভয়াবহ আকারে। এই অপরিকল্পিত প্রশিক্ষণের কারণে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা যে ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

জয়পুরহাট শহর বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাহবুবা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে জানান, শিক্ষক স্বল্পতার কারণে সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এক সঙ্গে ক্লাস নিতে হচ্ছে। এতে ভালোভাবে পাঠদান করা যাচ্ছে না।

পশ্চিম জয়পুরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাজিদ হাসান, নাঈম হোসেনসহ অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, ক্লাসে আপা বা স্যাররা নাই, অনেকে ট্রেনিংয়ে গেছেন। ফলে ক্লাস না হওয়ায় আমরা স্কুলে এসে খেলাধুলা করে বাড়ি যাচ্ছি। লেখাপড়া না হওয়ায় অনেকে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিও কমে গেছে আশঙ্কাজনক ভাবে।

জয়পুরহাট শহরের শান্তিনগর এলাকার সরওয়ার জাহান সেলিম, মাসুদ রানা, আদর্শপাড়া এলাকার হামিদুল আলমসহ অনেক অভিভাবক জানান, এতদিন ধরে শিক্ষকরা ট্রেনিংয়ে থাকায় বাচ্চাদের লেখাপড়ায় মন বসছে না, তারা খেলাধুলা আর দুষ্টুিম করে দিন কাটাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বদরুজ্জেহা জাগো নিউজকে জানান, বিষয়টি তিনি দেখবেন। জয়পুরহাট সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাইয়ার সুলতানা বাস্তবতা স্বীকার করে জাগো নিউজকে জানান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অন্যান্য প্রশিক্ষণার্থী দিয়ে বিকল্প উপায়ে বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হবে ।                                                        

জয়পুরহাট প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা (পিটিআইয়ের সহ-সুপারেনডেন্ট) ফয়জুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়ে এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। কিন্তু প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে সরকারের শিক্ষা বিভাগ হঠাৎ করেই গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করলে এই বিপত্তির সৃষ্টি হয়। তবে এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এ সমস্যার সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে।  

পিটিআই কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত প্রশিক্ষণার্থী দিয়ে কবে নাগাদ বিকল্প উপায়ে স্কুলগুলোতে পাঠদান করা হবে তা দেখার অপেক্ষা করছে কোমলমতি শিক্ষার্থীসহ উদ্বিগ্ন অভিভাবকগণ।

এমজেড/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।