চুয়াডাঙ্গায় কারাবন্দীদের ৭০ শতাংশই বিচারাধীন মামলার আসামি
বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ বন্দী রয়েছে। আর এই কারাবন্দীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ বিচারাধীন মামলার আসামি। অর্থ্যাৎ দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই তাদের আটক করা হয়েছে। আর প্রকৃত দোষী সাব্যস্ত কারাবন্দীর সংখ্যা এক তৃতীয়াংশেরও কম।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগার সূত্রে জানা যায়, কারাগারে বন্দীদের ধারণ ক্ষমতা ৩শ’ জন। বর্তমানে সেখানে রয়েছেন ৫৬৪ জন। কারাবন্দীদের মধ্যে ১৭ জন নারীসহ ৩৯০ জন হাজতি, ৬ জন নারীসহ ৯৪ জন বিনাশ্রম কয়েদী, ৩ জন নারীসহ ৭৯ জন সশ্রম কয়েদী, আরপি ১ জন এবং মায়ের সাথে শিশু ৪ জন রয়েছে।
এখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন বন্দী আসছেন। নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক কারাবন্দী মেঝেতে ৩৬ বর্গফুট জায়গা লাভের অধিকারী। কিন্তু ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত কারাবন্দীর কারণে প্রত্যেকের জন্য প্রাপ্য জায়গার পরিমাণ ১৫ বর্গফুটে এসেছে। কারাবিধি অনুসারে সাধারণ বন্দীরা দৈনিক ২,৮০০ থেকে ৩,০০০ গ্রাম ক্যালরি খাদ্য পায়। এছাড়া বন্দীদের জমাকৃত ব্যক্তিগত ক্যাশ হতে প্রয়োজন অনুযায়ী কারা ক্যান্টিন হতে প্রয়োজনীয় বৈধ মালামাল কেনার সুযোগ রয়েছে। কারা ক্যান্টিনে ছোলা-মুড়ি, চা, সিংগাড়া, টুথপেস্ট, লুঙ্গি, গামছা প্রায় সবই কেনা সম্ভব।
চুয়াডাঙ্গা কারাগারে কারা হাসপাতাল থাকলেও চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য কারা অধিদফতরের অধীনে সহকারী সার্জনের পদটি দির্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। এ কারণে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল থেকে মেডিকেল অফিসার ধার নিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হয়। যেটুকু দেয়া হয় তা শুধু নামে মাত্র প্রাথমিক পর্যায়ের। ফলে অসুস্থ কারাবন্দীদের যথার্থ চিকিৎসা সেবায় ব্যঘাত সৃষ্টি হয়। প্রয়োজনীয় ওষুধের অপর্যাপ্ত সরবরাহ, সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের অভাব ছাড়াও গর্ভবতী কারাবন্দীদের মাসে দু’বার করে শারীরিক পরীক্ষা করার কথা কারাবিধিতে থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। এমনকি রাতের বেলা জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসার জন্য কোন চিকিৎসক নেই।
কারাভ্যন্তরে খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা সেবা, পয়ঃনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহ পরীক্ষা করার জন্য কোন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমাজসেবা কর্মকর্তা নেই। কারাবন্দীদের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার জন্য নেই কোন মনোচিকিৎসকও। কারাবন্দী এবং কারা কর্মচারীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সার্বক্ষণিক একজন মেডিকেল অফিসার না থাকায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। সহকারি সার্জনের পদটি দ্রুত পূরণ হওয়া দরকার বলে তারা মনে করেন।
কারা অভ্যন্তরের সার্বিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কথা হলো কারাবন্দী আমিনুলের সাথে। তিনি জানালেন, বন্দীদের উপর কারা কর্মচারী এবং সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের অত্যাচার ও নির্যাতনের যে দীর্ঘ দুর্নাম এবং ইতিহাস তিনি বাইরে থাকতে শুনেছেন তার একটিও এখানে নেই। তবে বর্তমানে কারাগারে ধারণ ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ বেশি বন্দী অবস্থান করছেন। এতে কারা কর্তৃপক্ষও বিপাকে পড়েছেন। ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দী অবস্থানের কারণে দেখা-সাক্ষাত কক্ষেও প্রচণ্ড চাপ। বাথরুম, টয়লেটসহ সর্বত্রই বন্দীদের ভীড়। সাক্ষাতকক্ষে বন্দীদের স্বজনদের সাথে ভীড়ে চেঁচামেচির কারণে কথা স্পষ্ট শোনা যায় না।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কারাগারের জেলার মো. সোহেল আহম্মেদ জানান, কারাগারে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দী অবস্থান করছে। আদালত কোন বন্দীকে হাজতে পাঠালে কিংবা বিচারে সাজা দিলে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়। ফলে কারাগারে ধারণ ক্ষমতা যাই হোক না কেন কারা কর্তৃপক্ষ ওই বন্দীকে রাখতে বাধ্য থাকে।
তিনি আরো বলেন, কারাবন্দীদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবার, চিকিৎসা প্রদানসহ প্রয়োজন অনুসারে সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কারাগারে প্রতিটি ওয়ার্ডে রয়েছে রঙিন টেলিভিশন। যাতে বিটিভির অনুষ্ঠানমালা দেখার সুযোগ পায় বন্দীরা। প্রতিটি ওয়ার্ডে রয়েছে আটটি করে সিলিং ফ্যান। কারাগারে স্বচ্ছতার সাথে বন্দীদের শোয়ার জায়গা বণ্টন, খাবার বণ্টন, গোসলের পানি বণ্টন করা হচ্ছে। অসচ্ছল কারাবন্দীদের বিনা খরচে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে মামলা পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কারা বন্দীদের প্রতি অত্যন্ত মানবিক ব্যবহার করা হচ্ছে।
বন্দীদের সমস্যা অভিযোগ মনোযোগ সহকারে শোনা এবং সমস্যা লাঘবে কারা কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট রয়েছে। এছাড়া কারাগারকে শাস্তি কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনার পরিবর্তে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কারারক্ষীসহ সকল স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারিগণ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও তিনি জানান।
তিনি জানান, অপ্রতুল লোকবল নিয়ে কারাগারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হচ্ছে। কারাগারে নিরাপত্তা জোরদারে কারারক্ষীদের অনেককেই চাহিদা এবং প্রয়োজন মাফিক ছুটি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কারাগারের বন্দীদের কল্যাণমূলক কাজ সম্পর্কে তিনি জানান, কারাগারের বন্দীদের নৈতিক চরিত্র গঠনে বিপদগামী মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত প্রেষণা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বন্দীদের ধর্মীয় প্রার্থনার বাইরে ধ্যান ও মেডিটেশনের মাধ্যমে সংশোধনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
এসএস/পিআর