চামড়াটাই পুড়েছে, বাকিটা আগের মতোই আছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৫৩ পিএম, ১৭ জুলাই ২০১৭

ডানপিটে মেয়ের ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা পড়াশোনা করে একটা ভাল চাকরি করবেন। সবজিবিক্রেতা বাবার মুখে হাসি ফোটাবেন। ছোট ভাইয়ের পড়াশোনান খরচ চালাবেন, বিশ্রাম দেবেন দিন-রাত ঘরের কাজ করে যাওয়া মাকে।

পড়াশোনার পাশাপাশি সেকারণে নার্সিং ট্রেনিং, কম্পিউটার কোর্স, বিউটিশিয়ান কোর্স, হাতের কাজেও তুখোড় হয়ে ওঠার লড়াই চলছিল জয়নগরের মনীষার।

রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের মেয়ে তখনও ভাবতে পারেননি, এর চেয়েও বড় লড়াই অপেক্ষা করছে হাসপাতাল, থানা আর আদালতে। পাড়ায় ছোট থেকে দেখে আসা কয়েকটা মানুষ এক শীতের সন্ধ্যায় ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তারই মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে যাবেন!

সকালে ঘুম ভেঙে আয়নায় নিজের মুখটা চোখে পড়ে। আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় কত কথা! কত স্বপ্নের কথা। অথচ বীভৎস পোড়া একটা মুখ। গলা, বুক ও হাতের চামড়াগুলো গুটিয়ে গেছে। বাম চোখের জায়গায় একটা ঝাপসা গর্ত।

এক মগ নাইট্রিক অ্যাসিডের ঝাঁঝ পুড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু। স্বাধীনচেতা, তুখোড় এক মেয়ের দিকে তাকিয়ে কেবল ভয়ই পায় না, অনেকে তাকাতে পর্যন্ত চায় না তার দিকে। বাচ্চারা ভয় পায়  তাকে দেখে।

অথচ অ্যাসিড নিক্ষেপের আগেও লোকজন তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকত।এখনও দেখে, কারণটা শুধু বদলে গেছে। অ্যাসিডের ঘটনার পর একটা মামলা হয়েছিল। যে মামলায় গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট রায় দিয়েছে, মনীষাকে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে রাজ্য। জামিন পাওয়া অভিযুক্তদের মধ্যে পাঁচজনকে ফের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। যদিও মূল অভিযুক্ত সেলিম এখনও পলাতক।

‘ক্ষোভ’, ‘সুবিচার’, ক্ষতিপূরণ’, ‘নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন’; বাঁধাধরা শব্দগুলোর দিকে গল্পটার ঘুরে যাওয়ার কথা ছিল এর পরেই। সচরাচর তাই হয়। কিন্তু মনীষার কথা শুনলে ধাক্কা লাগে। খিলখিল করে হাসতে হাসতে তিনি বলছেন, একটু চামড়াই তো পুড়েছে আমার। সেজন্য বেঁচে থাকার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে? একটা ভাল চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে কি ঝকঝকে চামড়াই একমাত্র যোগ্যতা?

২৩ বছরের মনীষা বলেন, নিজের যোগ্যতায় একটা চাকরি পেয়ে কয়েক মাসের মধ্যেই ওই তিন লাখ টাকা রোজগার করে ফেলতে পারি আমি। পারবও। কিন্তু যে যন্ত্রণার পথ পার করতে হল, সেই ক্ষতির তো কোনো পূরণ হবে না। শুধু তখনই মনে হয়, পোড়ার দাগ মিলিয়ে না যাক, চোখটা যদি অন্তত সেরে যেত! হাসপাতালে ২১ দিন ভুল চিকিৎসা না হলে হয়তো বেঁচেও যেত চোখটা। এখনও চিকিৎসা চলছে তার।

চামড়াটাই পুড়েছে, বাকিটা কিন্তু আগের মতোই আছে। একটু চামড়া পুড়ে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছু হয়নি বলেও মনে করেন তিনি। আত্মবিশ্বাস, কোন পর্যায়ে পৌঁছালে নিজেকে এতটাও বুঝিয়ে ফেলতে পারেন কেউ! অথচ এখনও তাকে নিয়ে অনেকেই ফিসফিস করে কথা বলেন।  সেই সন্ধ্যার পর থেকেই মনীষা বুঝতে শুরু করেছিলেন, অ্যাসিডে শুধু মুখ পোড়েনি, তার চরিত্রটাকেও পুড়িয়ে দিয়েছে সমাজের একটা অংশ।

হাসপাতালের বিছানায় তখন শুয়ে মনীষা। চোখ-মুখ জড়িয়ে ব্যান্ডেজ। কানে ঢুকছিল, তার বেডের পাশে দাঁড়িয়েই কারা যেনো বলেছে, ভাল ঘরের মেয়েদের তো এমন হয় না!

তারা নাকি হাসপাতালে ‘দেখতে’ এসেছিল মনীষাকে! কয়েকদিন আগেও ট্রেনে গোটা কাহিনি শুনে এক সহযাত্রী প্রশ্ন করেছেন, শুধু অ্যাসিড? রেপ করেনি?

সমাজকর্মী ও নারী আন্দোলনে সামিল সুপর্ণা পালের নাগেরবাজারের বাড়িতে বসে ঘটনাটা বলতে বলতে আবার হেসে ফেলছিলেন মনীষা। যেন ভারী আমোদ পেয়েছেন।

মনীষা বলে চলেন, কোনো দিন স্বপ্নের রাজপুত্রের কল্পনায় নিজেকে ভাসাইনি। একটাই স্বপ্ন ছিল, বড় চাকরি করব। টিভি দেখে দেখে ইংরেজি আর হিন্দি বলতাম। নাচের স্টেপ তুলতাম। ‘স্মার্ট’ হওয়ার চেষ্টা করতাম। পাড়ার লোকজন তা নিয়ে কানাকানি করত। সবার ধারণা, মেয়েটার এত বেড়েছে কেনো?  ঘর-সংসারের কাজ না শিখে সারাদিন টো টো করে এই কোর্স, সেই কোর্স। তার ওপর আবার বিএ পাশ!

মনীষা আজ বোঝেন, যারা তাকে অ্যাসিড মেরেছিল আর যারা হাসপাতালে দাঁড়িয়ে তার চরিত্র-চর্চা করেছিল, তাদের গা-জ্বালার জায়গাটায় খুব একটা ফারাক হয়তো নেই।

ঈদে বাড়ি গিয়ে দেখেছিলেন, বুক ফুলিয়ে ঘুরছে জামিনে মুক্ত অভিযুক্তরা। তখনই আরও এক বার দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়েছিল সংকল্প। তাদের সামনে গিয়েই হাসিমুখে দাঁড়াতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে, কিছুই পোড়াতে পারেনি তাদের অ্যাসিড। পোড়াতে পারেনি ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়াগুলো। আজও জোরে গান চালিয়ে নাচেন মনীষা। আজও ঈদের দিনে তার কাছে সাজতে আসেন পাড়ার মেয়ে-বউরা। তিনি যে বিউটিশিয়ান কোর্সের ভাল ছাত্রী ছিলেন।

তবে এমনও অনেকে আছে, যারা তার সঙ্গে সহজ হতে পারেননি আর। মনীষার সত্যিকারের কষ্ট হয়, যখন বাচ্চারা তাকে দেখে ভয় পায়। তখনই চোখের কোণটা একটু ভিজে ওঠে। কিন্তু নিজের গল্প শুনে আনকোরা কেউ কেঁদে ফেললে মণীষাই তাকে মনে করিয়ে দেন, এটা কোনো দুঃখী মেয়ের কথা নয়। সবাই নিজের লড়াই করে বাঁচে, আমিও বাঁচছি। খুশিতে বাঁচছি।

কিন্তু সমাজের বাঁকা দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে কি না জানতে চাইলে উত্তর আসে, আমার এই পুড়ে যাওয়া মুখটাই আসলে সমাজের আয়না। এই মুখেই লুকিয়ে আছে আমার মতো অসংখ্য মেয়ের লড়াই। নিভে আসা বিকেলের রোদ্দুর তখন ঝিকমিক করছে মনীষার চোখেমুখে। আনন্দবাজার।

কেএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।