একজন গর্বিত মায়ের ক্লিনার ছেলে ইদরিসের দুঃখগাথা

সাইফুজ্জামান সুমন
সাইফুজ্জামান সুমন সাইফুজ্জামান সুমন , সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:৩৬ পিএম, ১৬ জুলাই ২০১৭

“আমি ক্লিনার হিসেবে জন্ম নেইনি। আমি ছিলাম নিষ্পাপ শিশু; যে উৎকট গন্ধ পেলে বমি করত। আমার পরিবারেরও কেউ কখনও ক্লিনার ছিলেন না। কিন্তু অন্যের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে আমার জীবনের ৭০ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। আমি এই কাজটি শুরু করেছিলাম আমার পরিবারকে ক্ষুধা থেকে রক্ষা করতে। যেদিন আমি একজন ক্লিনার হিসেবে এই কাজ শুরু করেছি; সেদিন থেকে আমার পরিবারের পরিচিতি বদলে গেছে ‘ক্লিনার পরিবার’ হিসেবে।”

নিজের জীবনের গতি পরিবর্তনের কষ্টের কথা এভাবেই বলছিলেন ৮০ বছর বয়সী পেশায় ক্লিনার ইদরিস আলী। বাংলাদেশি আলোকচিত্রী জেএমবি আকাশ ইদরিস আলীর জীবনের দুঃখগাথা তুলে ধরেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ইংরেজিতে দেয়া এক পোস্টে। সেখানে উঠে এসেছে ইদরিস আলীর নিষ্পাপ শিশু থেকে ক্লিনার হয়ে ওঠার গল্প। তার এই গল্পের আড়ালে লুকিয়ে আছে সমাজ বাস্তবতা ও সততার কিছু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

ইদরিস আলী বলেন, আমার মা’কে ডাকা হতো ক্লিনারের মা বলে। এই ৭০ বছরে কেউ আমাকে বলেনি যে, ‘আমার কাজটি গুরুত্বপূর্ণ অথবা আমি গুরুত্বপূর্ণ। আমি খেয়াল করেছি, কেউ মানুষ হিসেবে আমার দিকে তাকায় না; তারা আমার চোখের দিকেও তাকায় না অথবা কাছেও আসে না। এমনকি তাদের বাড়িতেও আমাকে বসতে দেয় না।’

সবার কাছে আমি শুধু একজন সুইপার অথবা ক্লিনার। কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে না, সকালে জেগে উঠতে কেমন লাগে? সকালের নাস্তা না করেই ময়লার ভাগাড়ে অথবা নর্দমায় কাজ করতে কেমন লাগে?

‘আমার মা যখন প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলেন; তখন একদিন মায়ের কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম এবং তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি কেন তার কাছে ক্ষমা চাই। আমি বলেছিলাম, তিনি কয়েক দশক ধরে শুধুমাত্র আমার কারণে একজন ক্লিনারের মা হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। আমি তাকে ছোট করেছি, কারণ একজন মেকানিক অথবা শ্রমিকও হতে পারিনি।’

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে এমন একজন ব্যক্তি হয়েছি যে; যা অন্য কেউ হতে পারেনি। তিনি আমাকে বলেন, নিজে দূষিত হয়ে অন্যদের ময়লা খুব কম মানুষই পরিষ্কার করতে পারে। আর অবিশ্বাস্য হচ্ছে যে, এই কাজটিই একজন করছে তার পরিবারের জন্য।’

‘আমাকে নিয়ে মা কতটা গর্বিত, সেদিন জানিয়েছিলেন। কারণ আমি তার খাবারের ব্যবস্থা করতাম আমার সৎ উপার্জন থেকে।’

‘মায়ের মৃত্যুর পরও, আমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি; ময়লা পরিষ্কার করছি। একদিন ময়লার ভাগাড়ে একটি স্বর্ণের চেইন পেয়েছিলাম। সহকর্মীরা দেখে ফেলার আগে দ্রুতই তা লুকিয়ে ফেলি। বাড়িতে ফেরার পর আমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হই। কিন্তু চেইনটি আমার পকেটেই ছিল; তখন নিজেকে দূষিত মনে হচ্ছিল।’

ইদরিস আলীর সততা

‘আমি ওইদিন খেতে পারি নাই। সারাদিন চিন্তা করেছি কীভাবে এই চেইনটি আমার জীবনের গতিপথ, গন্তব্য পাল্টে দিতে পারে। আমার বোনের বিয়েতে চেইনটি উপহার দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম; বিক্রি করে ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করেছিলাম। আমার বিস্তৃত স্বপ্নের জগতে এমন কিছু ছিল না, যা আমি দেখিনি। কিন্তু আমার জীবনে এই প্রথমবারের মতো শান্তিমতো ঘুমাতে পারি নাই।’

ইদরিস আলী বলেন, ‘কয়েকদিন পর চেইনটি বিক্রি করে টাকা হাতে নেই। এই টাকা প্রায় এক মাস আমার সঙ্গে ছিল। এই একমাসের কোনো রাতেই আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারি নাই। ঈদের আগে আমাদের বস্তির এক দোকানে বসে ছিলাম। এমন সময় একটি ছেলে ওই দোকানে আসে। দোকান মালিকের কাছে কিছু চাল চায়; যাতে ঈদের দিন তার পরিবার একটু খেতে পারে।’

দোকান মালিক তাকে গালমন্দ করে এবং সে চলে যায়। আমি তাকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যেতে দেখি।

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যে অর্থ ছিল তা দিয়ে ওই রাতে বস্তির পরিবারটির জন্য কিছু বাজার করেছিলাম। আমার হাতে থাকা সব টাকা খরচ করেছিলাম। প্রত্যেকেই অবাক হয়ে আমার কাছে জানতে চায় ঘটনা কী? আমি কারো কাছে মিথ্যা বলিনি আবার সত্যও বলিনি।’

‘ওই রাতে যখন ঘুমাতে যাই; তখন আবারও আমি দরিদ্র ছিলাম। একজন দরিদ্র ক্লিনার তার তোষকের ওপর শুয়ে আছে। কিন্তু ওই রাতে আমি শান্তিতে ঘুমাতে যাই। মৃত্যুর পর সেই রাতে প্রথমবারের মতো মাকে স্বপ্ন দেখেছিলাম।

আমি সুন্দর একটি শাড়ি পরিহিত অল্প বয়স্ক এক নারীকে দেখি। তিনি হেসে হেসে সবাইকে বলছিলেন, ‘আমিই সেই ক্লিনারের মা। আমার ছেলে দূষিত হতে পারে কিন্তু তার হৃদয়ের মতো কারো হৃদয় পরিষ্কার নয়।’

আলোকচিত্রী জিএমবি আকাশের ফেসবুক পেইজে ইংরেজি স্ট্যাটাস থেকে অনূদিত।

এসআইএস/আরআইপি

আমিই সেই ক্লিনারের মা। আমার ছেলে দূষিত হতে পারে কিন্তু তার হৃদয়ের মতো কারো হৃদয় পরিষ্কার নয়।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।